মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের বিষয়বস্তু।

 মৃত্যক্ষুধা উপন্যাসের মূলভাব।

কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্মটি হচ্ছে মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস। আলোচ্য উপন্যাসের পটভূমি কৃষ্ণনগরের বিষয়, সমকালীন সামাজিক ,রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যা। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতনের প্রক্ষাপটে হতাশা আর নৈরাশ্যকে পেছনে ফেলে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যায়। একদিকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে দুঃখ দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের করালগ্রাস এবং রাজনৈতিক সংকট।এই দ্বিবিধ ঘটনার প্রেক্ষিতেই মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের সৃষ্টি।




মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস নজরুল সমাজের নিম্নশ্রেণীর নিঃস্ব অসহায় মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। ধর্মান্তরিত প্রান্তবর্গীয় খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের অভাব দারিদ্র আর হতাশা উপন্যাসের অন্যতম বিষয়। এই উপন্যাসের মাধ্যমে নজরুল গেয়েছেন মানবতার জয়গান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মহিমা ও মাহাত্ম্য এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের শিল্পমূল্য

আলোচ্য উপন্যাসে নজরুল কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়ক এলাকার দারিদ্র্যক্লিষ্ট সংসারের বিষয়কে ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছেন। কৃষ্ণনগরের মানুষের ভাঙ্গা ঘর,অনাহারক্লিষ্ট জীবন সব মিলিয়ে এক সুনির্দিষ্ট পটচিত্র। যা বাস্তবতার রৌদ্র লোকে স্নাত, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির নানা রঙে বৈচিত্র্যপূর্ণ। দিনমজুর অধ্যুষিত কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়ক এলাকার কথা উল্লেখ্য-


"ওমান কাতলি সম্প্রদায়ের দেশি কনভার্ট ক্রিশ্চানে মিলে গা ঘেষাঘেষি করে থাকে…হিন্দু ও দু- চার ঘর আছে…চানাচুর ভাজা ঝাল ছিটের মত।"


এদের বাসস্থান সংকটও তীব্র। ঘরের অভাবে ঘরের চাল ফুটো হয়ে গেলেও তার সারাবার সামর্থ্য নেই। এসবের মধ্যেই চলে এদের জন্ম মৃত্যুর পালা, দৃষ্টান্ত:

"উনুনশালে পাঁচির ছেলে হয়েছে।... যেটা উনুনশাল, সেইটেই ঢেকিঘর,সেইটেই রান্নাঘর এবং সেইটেই রাত্রে জন সাতেকের শোবার ঘর।"


কৃষ্ণনগরে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ সবই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারক রসে সিঞ্চিত করেছেন ঔপন্যাসিক। মৃত্যুক্ষুধায় জীবনের শেকড় প্রাকৃত জীবনের গভীরে গ্রথিত।এই প্রাকৃত জীবন বাইরে যতই সরল দেখাক,ভেতরে বহুভঙ্গিক বৈচিত্রের অধিকারী।


নজরুলের মতে, চাঁদ সড়ক এলাকার মানুষের জীবনে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছে কেবল ক্ষুধা। এই ক্ষুধার কারণেই মেজবৌ, প্যাঁকালের মত মানুষেরা ধর্মান্তরিত হয়েছে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পেছনে কোন ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা বা আকৃষ্টতা লক্ষ্য করা যায় না। বরং তৎকালীন সময়ে মানুষদের পরিকল্পিতভাবে রিক্ত এবং নিঃস্ব করার সুদূর প্রসারী প্রবণতা বিদ্যমান। কেননা ক্ষুধার তাড়নার সামনে মানুষের দৃঢ়তা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না।


যার প্রেক্ষিতে মেজবৌর মতো প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে।ক্ষুধার প্রসঙ্গে নিম্নে একটি মন্তব্য:

"বিশ্বের সব দুর্গতি দুর্ভোগের মূল কারণ ক্ষুধা। ক্ষুধা মানুষকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করে,অপরাধের দিকে ধাবিত করে।ক্ষুধা চরমপন্থী হওয়ার শিক্ষা দেয়,ক্ষুধা নারীর সতীত্ব বিক্রি করতে বাধ্য করে।ক্ষুধার জ্বালা ভীষণ জ্বালা।এ আঘাত অত্যন্ত মারাত্মক"


উপন্যাসের শুরুতে গজালের মা এবং হিড়িম্বার ঝগড়ার সময়কালে পুটির মার সাক্ষাৎও পায়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তারা জাত তুলে গালাগাল করে।


"এই হিড়িম্বা ফস করে তার চুল খুলে দিয়ে একেবারে এলোকেশী বামা হয়ে.. তুই আবার কে লো উঝড়ো খাগী"


এইসব অশ্রাব্য গালাগাল এর মাধ্যমে মূলত তৎকালীন সমাজের মানুষের অমার্জিত জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।নিম্নশ্রেণীর প্রতিনিধি প্যাঁকালে দরিদ্র, কিন্তু সে জানে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হয়।শত কষ্টের পরও সে সংসারের হাল ছাড়িনি। ঘরে তার দারিদ্র্যের যন্ত্রনা আর নিরন্তর ক্ষুধা। ক্ষুধার তাড়নায় বিড়ালের এঁটো করা দুধের সাথে মুরগির খাবারের জন্য রাখা খুদ দিয়ে রান্না করা ক্ষীর পরমানন্দের সাথে খায় ক্ষুধিত শিশুরা।


ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটানো যেখানে দুঃসাধ্য ব্যাপার,সেখানে সৌখিনতা বা চিকিৎসার খরচ করা অসম্ভব। যে কারণে প্যাঁকালে চার আনা দামের আয়না কিনেও প্রয়োজনের তাগিদে বিক্রি করে ফেলে। আবার সেজবৌ অসুস্থ হওয়ার পরও চিকিৎসা করতে পারেনা। দু-মাসের শিশু দুধ না পেয়ে ক্ষীণকণ্ঠে কাঁদে।আর ক্ষুধা নামক প্রবৃত্তিকে অবলম্বন করে ইংরেজ মিশনারীরা অযথাচিতভাবে অসুখের পথ্যদিয়ে,অন্নের সংস্থান করে, অসহায় মানুষকে তারা স্বধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে।ইংরেজরা শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব করেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্মীয় আগ্রাসনও চালিয়েছে সমানভাবে।


মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের প্রধান সুর ক্ষুধা। ক্ষুধাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন লেখক।নিম্নবিত্ত-হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে ক্ষুধায় যেন আদিম প্রবৃত্তির অন্যতম।কৃষ্ণনগরের অভাব দুঃখের বর্ণনায় লেখক বলেছেন, "এরা সব ভোলে,ভোলে না কেবল তাদের অনন্ত দুঃখ,অনন্ত অভাব। "অভাব তাড়িত জীবনে অতিথি যেন এক বিড়ম্বনা। তাই লেখক বলেছেন-


"অভাবের দিনে প্রিয় অতিথি আসার মত পীড়াদায়ক বুঝি আর কিছু নেই।"


ক্ষুধার নির্মম চিত্র লেখক বর্ণনা করেছেন একালের পরিবারকে কেন্দ্র করে-


"প্যাঁকালে চলে যাবার পরেই তাদের দ্বাদশটি ক্ষুধার্ত ভাইপো ভাইঝি মিলে যে বিচিত্র সুরে ফরিয়াদ করতে লাগল ক্ষুধার তাড়নায়,তাতে অন্নের মালিক যিনি তিনি এবং পাষাণ ব্যতীত বুঝি আর সবকিছুই বিচলিত হয়।" 


অশিক্ষিত ও দরিদ্র মুসলমানদের ওপর ইসলামের নিয়মকানুনের ব্যাপারে সমাজের কাঠমোল্লাদের দৌরাত্ম্য।সন্তানের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে মেজবৌ খ্রিস্টান হলে মোল্লারা ফতোয়া জারি করে-


"প্যাঁকালের মা আপাতত তার বাড়ির ছাগল কয়টা বিক্রি করে পনেরো টাকা জোগাঢ় করে দেবে নইলে সে সমাজের পতিত থাকবে।"


অন্যদিকে মুসলমান সমাজের দরিদ্র ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে যে পাদ্রীরা তাদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছে সেজন্য তাদের প্রতি ঘৃণাও বর্ষিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে। সমকালীন সমাজের চিরকালীন প্রথা হিসেবে মেয়ের প্রথম সন্তান পিতৃগৃহে জন্ম নেয়,প্যাঁকালের বোনে পাঁচির ক্ষেত্রেও এই চিরকালীন প্রথার প্রযোজ্য ঘটে।এর মধ্য দিয়ে নজরুলের সমাজসচেতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।


কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে প্রত্যক্ষ বাস্তবের অন্তরঙ্গ বিবরণ তুলে ধরেছেন।নিম্নবিত্ত মানুষের যাপিত জীবন,তাদের সুখ-দুঃখ অভাব-অনটন শোষণ-বঞ্চনা দারিদ্র্য ও দারিদ্র্যমুক্তির সংগ্রাম সবই আলোচ্য উপন্যাসের বর্ণিত বিষয়ে।ঔপন্যাসিকের গভীর অন্তর্দৃষ্টির ফলেই জীবনের এমন বিশ্বস্ত সূত্র উদ্ভাসিত হয়েছে মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস।


মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের প্লট।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের বিষয়বস্তু।।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের অলংকার।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের মেজ বউ চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।মৃত্যুক্ষুধা কোন ধরনের রচনা।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস কাদের পটভূমিতে রচিত।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের সমালোচনা।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের নামকরণ।মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের মূলভাব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ