ঠাকুরমার ঝুলি গল্পের বিষয়বস্তু এবং সমাজ চিত্র।

ঠাকুরমার ঝুলি গল্পের বিষয়বস্তু এবং সমাজ চিত্র।

ঠাকুরমার ঝুলি বাংলা শিশুসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় রুপকথার সংকলন। এই গ্রন্থের সংকলক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রূপকথার গল্পগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে।বিভিন্নভাবে সংগৃহীত হলেও দক্ষিণারঞ্জণের লেখনীর গুণে গল্পগুলো হয়ে উঠে শিশু মনোরঞ্জক। ৮৪ টি চিত্র সংবলিত ঠাকুরমার ঝুলির চিত্র অঙ্কন করেছেন গ্রন্থকার স্বয়ং।


গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার 'ভট্টাচার্য এন্ড সন্স' প্রকাশনা সংস্থা হতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন। এরপর থেকে এর শত শত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। রিনা প্রীতিশ নন্দী কর্তৃক অনূদিত এর একটি ইংরেজি সংস্করণও বের হয়েছে।



ঠাকুমার ঝুলি শিশু সাহিত্য বা রূপকথার বই হিসেবে আখ্যায়িত হলেও, ঐতিহাসিক বিবেচনায় এ গ্রন্থের রয়েছে ভিন্ন একটি তাৎপর্য। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালির মধ্যে যে অভূতপূর্ব সাড়া জেগে ছিল, তার মৌলিক চরিত্র ছিল স্বদেশপ্রেম ও ঐতিহ্যপ্রীতি। আবহমানকাল ধরে মুখে মুখে প্রচলিত রূপকথা, লোককথা, ব্রতকথাগুলো বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যিক সম্পদ।

এগুলো বাঙালির মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে এক অখণ্ড আভিজাত্য ঐতিহ্যবোধ। তাই সুয়োরানী দুয়োরানী আর রাক্ষস খোক্ষসের কাহিনী কেবল কৈশোরিক আন্দোলনের উৎসাহী নয়, বরং তা উপনিবেশবাদবিরোধী আপন ঐতিহ্যিক সচেতনতার দলিল। এই দৃষ্টিকোণের বিবেচনা করলে ঠাকুরমার ঝুলিকে আমরা একটি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে পারি।

স্বদেশী সচেতন ও তার উল্লেখযোগ্য লক্ষণ ছিল বাংলার নিজস্বতাকে সন্ধান ও সংরক্ষণ করা। দক্ষিণারঞ্জনের মাঝে স্বদেশী চেতনার এই বৈশিষ্ট্য ভিন্নমাত্রা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। আমাদের বিবেচনায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি উত্তাল উন্মীলনের দিনে ঠাকুমার ঝুলির প্রকাশ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা সঞ্চারি উজ্জ্বল উদ্ভাসন।


বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯০৫ সালে দেশে যেন সমুদ্রের তুফান আসেছিল। সেই অদ্ভূতপূর্ব প্রচন্ড আঘাতে বাঙালির জীবনে যেন নবজাগরণ দেখা দিল, তাহাতে তাহার আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠল। ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান জেগে উঠলো। রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাটি বাংলার জল বাঙালি হৃদয়ের তুলিতে ঝংকৃত হতে লাগল, ' ডানহাতে যার খড়গ জ্বলে বাঁ হাতে করে শঙ্কাহরণ' সেই রুদ্রাণী কল্যাণী দেশ জননীর 'সোনার মন্দিরে' ভক্ত প্রাণের লক্ষ লক্ষ দীপ শিখা জ্বলে উঠলো।

তৎকালীন সময়ে জনসমাজের জাদু মন্ত্র এবং অলৌকিকতায় মানুষ বিশ্বাস করত। তাই লোক গল্পের তথা ঠাকুমার ঝুলির অনেক গল্পেই জাদু ও অলৌকিকতা উপস্থিত।

'কাঞ্চন-মালা', 'সাতভাই চম্পা', 'কিরণমালা', 'মণি-মালা', 'কলাবতী রাজকন্যা', 'কাঁকন-মালা' সব শৌখিন উচ্চতার 'রমণী'। চিরায়ত বা আবহমান ঐতিহ্যে – তারা এক কৃষ্টিতে গড়া। ঠাকুরমার ঝুলির প্রায় সব গল্পই নারীপ্রধান। নারীর অসহায়ত্ব যেমন এতে ফুটে ওঠে, তেমনি রূপময় ঐতিহ্যেরও তাতে প্রকাশ ঘটে। তবে পুরুষ তাতে একপ্রকার কর্তৃত্বপ্রবণ, বলশালী এবং আধিপত্যবাদী।

সেখানে নারীরাও তা মান্য জ্ঞান করেছে। কিন্তু পুরুষ মূল্যবোধে এর গুরুত্ব কী? পুরুষ অসহায় নারীকে উদ্ধার করতে এসেছে। পুরুষ কখনো শোষকও, আবার পুরুষের চোখেই নারীর অভিজ্ঞতাও সমাজে বিচার্য বিবেচিত হয়েছে। সেভাবেই তারা সমাজে বা গল্পে প্রতিষ্ঠিত। ফলে তাদের লিঙ্গীয় মর্যাদাও ওই মাপেই পুনর্গঠিত। ফায়ারস্টোনের তত্ত্বও তাই বলে। ঠাকুরমার ঝুলির অলৌকিক শক্তি বা অতিপ্রাকৃত শক্তিও নারী-পুরুষ মনস্তত্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। নারী এবং পুরুষ উভয়ই অলৌকিক শক্তি দ্বারা প্রভাবাচ্ছন্ন।


এগুলো অনেকটা টোটেমিক মিথের মতো অন্তর্লীণও বটে। রাক্ষস-খোক্কস থেকে শুরু করে নানা অবাস্তব প্রবণতা এ মিথের অন্তর্ভুক্ত, প্রশ্রয়ভুক্তও। প্রসঙ্গত বলা যায়, 'প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই Taboo-র উদ্ভব। ট্যাবু অতিক্রম করে যাওয়ার অর্থ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়া নিজের বিণাশ ডেকে আনা। নীলকমল আর লালকমল' গল্পে রাক্ষসীর গর্ভে নীলকমলের জন্ম।


 'নীলকমলের নাম শুনিয়া খোক্কসেরা ভয়ে তিন হাত পিছাইয়া গেল! নীলকমল আর জন্মে রাক্ষসী-রানীর পেটে হইয়াছিলেন, তাই তাঁর শরীরে কিনা রাক্ষসীর রক্ত! খোক্কসেরা তাহা জানিত। সকলে বলিল, – 'আচ্ছা নীলকমল কি-না পরীক্ষা কর।' শেষাবধি নীলকমলের দ্বারাই লালকমল রক্ষা পায়। নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করে – যে খল, সে পরাস্ত হয়। 


বস্ত্তুত, খল চরিত্রের উদ্ভব সমাজে নেতি-শক্তির প্রতীকায়নে। হতে পারে তারা পুরুষ বা নারী। মানুষের ভেতরে 'সত্যের জয় মিথ্যার ক্ষয়' ভাবনাটি সামষ্টিক অবচেতনে সৃজিত। সেজন্য নানা প্রতীকের মাধ্যমেও তার রূপকথাশ্রয় ঘটে। এই প্রতীকায়ণে মানবমনের অবচেতন বা নির্জ্ঞান স্তর প্রণীত। একই সঙ্গে তা দ্বান্দ্বিক চিত্রার স্বরূপে মানুষের সহজাত ও পূর্বধারণায় পুনর্গঠিত।


ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলোর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে করলে 'হিউম্যান কগনিশন ' ধারণায় যেখানে মানুষের প্রাণীতে রূপান্তর এবং প্রাণীর মানুষে প্রত্যাবর্তনের রূপকীয় তাৎপর্য নজরে আসে। গল্পগুলোর ভেতর দিয়ে আদি-নৃগোষ্ঠীর সংস্কার-বিশ্বাস কিংবা স্বপ্ন টোটেমকে প্রকাশ্য করেছে। 'কলাবতী রাজকন্যা' ভূতুম আর বানরের যে রূপকধর্মী তাৎপর্য তাতে ট্যাবু ও টোটেমিক ভূমিকাটি জীবনের গূঢ় রহস্যেরই ইঙ্গিত দেয় :


কদিন যায়। একদিন রাত্রে, বুদ্ধের ঘরে বুদ্ধ, ভূতমের ঘরে ভূতম, কলাবতী রাজকন্যা, হীরাবতী রাজকন্যা ঘুমে। খুব রাত্রে হীরাবতী কলাবতী উঠিয়া দেখেন, – একি! হীরাবতীর ঘরে তো সোয়ামী নাই! কলাবতীর ঘরেও তো সোয়ামী নাই! কী হইল, কী হইল? দেখেন, – বিছানার উপরে এক বানরের ছাল, বিছানার উপরে এক পেঁচার পাখা।


'অ্যাঁ – দেখ! – তবে তো এঁরা সত্যিকার বানর না, সত্যিকার পেঁচা না।' দুই বোন ভাবেন! – নানান খানান ভাবিয়া শেষে উঁকি দিয়া দেখেন – দুই রাজপুত্র ঘোড়ায় চাপিয়া রাজপুরী পাহারা দেয়। রাজপুত্রেরা যে দেবতার পুত্রের মতো সুন্দর!গন্ধ পাইয়া রাজপুত্র ঘোড়া ফেলিয়া ছুটিয়া আসিলেন।


নৃ-জাতির ও জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক অবচেতনার প্রতীকায়িত স্বরূপ এভাবে নির্ণীত হয়েছে ঠাকুরমার ঝুলির আখ্যানে। স্বপ্ন-কল্পনার সাবলীল সম্বন্ধটি ট্যাবু-টোটেমের ভেতর দিয়ে বাস্তব হয়ে উঠেছে। এ-বাস্তবতা দীর্ঘ ধারাক্রমে রাক্ষস-খোক্কস কিংবা বেঙ্গমা- বেঙ্গমীর একীভূত প্রাণ-ধারণায় প্রতিষ্ঠিত। যেটি একটি জনগোষ্ঠীর প্রতীকী সারসত্য। বস্তুত, ঠাকুরমার ঝুলির শিল্পস্বরূপে সারসত্যাটি এমন মর্মরূপের ভেতরে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।


ঠাকুরমার ঝুলি সামগ্রিকরূপে হয়ে ওঠে এক সম্পাদশীল উপভোগ্য রচনালেখ্য। ভগ্নাদিমির প্রপ, মিখাইল বাখতিন, ক্লোদ লেভি স্ত্রাউসের তত্ত্ব ছাড়াও পোস্ট-কলোনিয়াল ব্যাখ্যায় ঠাকুরমার ঝুলির আলাদা একটি পাঠ হতে পারে। তাতেও আনা যেতে পারে নতুন মাত্রা। কেননা টোটেমিক মিথের যে-পারাবত এখানে রচিত হয়েছে তা যে কোনো নৃগোষ্ঠীর লোক-মনস্তত্ত্বের এক দলিল। 

সেখানে গৃহীত হয় সমকাল-ধারণায় ঐতিহ্যিক নবরূপায়ণ। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে এমন ধারণা-জ্ঞানের কিছু ইঙ্গিত থাকল কিন্তু এর জন্য আলাদা নিবিড় পাঠ নিশ্চয়ই অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রসঙ্গত, তারই টাইপ-মোটিফ ও ইনডেক্সের পাঠ এখানে গৃহীত। রবীন্দ্রনাথ 'বড় স্বদেশী জিনিষ বলেছেন, তাতে চরিত্র (রাজকীয়, অমাত্য, পরিচারক পরিচারিকা, খল, অশরীরী, পশুপক্ষী, দেব-দেবী), খাদ্যসামগ্রী, পরিধেয় বসন, রত্নালংকার, গৃহ-বৃক্ষ, ফুল-ফল, পরিবহন, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, প্রসাধন, নদী-পাহাড়-সাগর, গ্রহ-অন্তরীক্ষ, খেলনা ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উপকরণে ভৌগোলিক কৃষ্টির সবকিছু প্রামাণ্য বলে বিবেচ্য মনে করেছেন।


আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই তো একে বলেছিলেন 'জাতির আশায় স্বপ্নের ভাষায় অভাবনীয় সত্য সাহিত্য।' দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি আমাদের চিরায়ত ও সমগ্রতাস্পর্শী চেতনার উপাচারে ঋদ্ধ। এ-গ্রন্থের 'trickster'রা এই গেস্নাবাল বিশ্বে এখনো দুর্লক্ষ্য নন । তাই তো ঠাকুরমার ঝুলির রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকদের এখনো আগ্রহ সৃষ্টি করে চলেছে।

ঠাকুরমার ঝুলি গল্পের মূল বিষয়বস্তু।ঠাকুরমার ঝুলি কে সংগ্রহ করেন।কলাবতী রাজকন্যা গল্পের বিষয়বস্তু। ঠাকুরমার ঝুলি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ