বিসর্জন নাটকের ট্র্যাজেডি।

ট্র্যাজেডি হিসেবে বিসর্জন নাটক বিশ্লেষণ কর।

ট্র্যাজেডিকে বাংলায় বিয়োগান্ত বা বিষাদান্ত নাটক বলা হয়। ট্র্যাজেডি নাটকের কাহিনীর পরিণতিতে বিয়োগ, বিচ্ছেদ বা বিষাদের সৃষ্টি হয়। ট্র্যাজেডি নাটকের বিষয় সামান্য ঘটনা নয়, শক্তিমান এবং প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের সংগ্রাম ও তার করুণ পরিণতি ট্র্যাজেডির বিষয়। প্রবলের পরাজয় ও লাঞ্ছনা, দুর্দশা ও ক্ষত-বিক্ষত পরিণতি দর্শকের মনে করুণা ও ভয়ের সঞ্চার করে। তার বেদনায় দর্শক বিহ্বল হয়।



ট্র্যাজেডির নায়ক-নায়িকা শেষে পরাজিত হয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নায়কের অনমনীয় শক্তি ও তার জীবন। তবু তার জীবনযুদ্ধের মহত্ব দেখে আমরা বিমুগ্ধ হই। নায়কের পতনের আর্ত হাহাকারে কেঁপে ওঠে দর্শকের হৃদয়। ট্র্যাজেডির শোচনীয় পরিণতির জন্য আমরা যুগপৎ ভীত ও আনন্দিত হই। ভীত হই একজন বীরের মৃত্যুর জন্য, আনন্দিত হই একজন বীরের মহৎ সংগ্রাম অবলোকন করে।


‘বিসর্জন' রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ নাটকের লক্ষণাক্রান্ত ও বস্তুধর্মিতার কিঞ্চিৎ সম্পর্কযুক্ত। নাটকে লিরিক অংশের প্রাধান্য বেশি এবং একটা ভাব বা তত্ত্বকে রূপায়িত করবার অপ্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য বর্তমান। তবুও এই লিরিক ও তাত্ত্বিক ভাব-কল্পনা নাট্যরুপে পরিবর্তিত হয়ে সুন্দর নাটকীয় রসের সৃষ্টি করেছে। অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিণতিস্বরূপ করুণ বিয়োগান্ত ঘটনায় নাটকটির পরিসমাপ্তি হওয়ায়, নাটকটিকে রোমান্টিক ট্র্যাজেডি বলে অভিহিত করলে এর স্বরুপ বুঝতে সুবিধা হয় বটে, তবে পরিপূর্ণ রোমান্টিক ট্র্যাজেডির আদলে 'বিসর্জন' গঠিত নয়।


ত্রিপুরা রানী নিঃসন্তান গুণবর্তী ক্ষুদ্র প্রাণের জন্য ব্যাকুল, তাকে স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে জীবন সার্থক করতে চায়, কিন্তু প্রাণলাভের জন্য শত শত প্রাণ ধ্বংস করতে সে উদ্যত। অপর্ণার সন্তানতুল্য ছাগশিশু বলি দিলে সে রাজার কাছে আবেদন জানায়। রাজা তার রাজ্যে বলি বন্ধ ঘোষণা করে। শুরু হয় প্রথাধর্মের ধারক-বাহক রঘুপতির সাথে মানবধর্মের প্রতিভূ গোবিন্দমাণিক্যের দ্বন্দ্ব।

ব্রাহ্মণ রঘুপতির বিশ্বাস ধর্ম রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার উপর অর্পিত। রাজার আদেশে মন্দিরে পূজার বলি নিষিদ্ধ হলে রঘুপতির তেজ ও দম্ভ চূর্ণ হয়, সে ক্রোধে জ্বলে ওঠে, ক্রোধাগ্নি ছড়িয়ে দেয় সর্বস্তরে, সকলকে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে। যুবরাজ নক্ষত্র রায়কে সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে রাজহত্যার প্ররোচিত করে, পুত্রতুল্য শিষ্য জয়সিংহকে বোঝায়

"রাজরক্ত চাই দেবীর আদেশ।"

জয়সিংহ রাজহত্যায় ব্যর্থ হলে রঘুপতি আবার জ্বলে ওঠে, জয়সিংহকে দিয়ে দেবীর পা স্পর্শ করিয়ে প্রতিজ্ঞা করাতে সক্ষম হয়, জয়সিংহ প্রতিজ্ঞা করে— "আমি এনে দেব রাজরক্ত শ্রাবণের শেষ রাতে দেবীর চরণে। "


তাতেও রঘুপতি শান্ত হয় না, তারই চক্রান্তে মন্দিরের প্রস্তর নির্মিত জড় প্রতিমার মুখ ফিরে যায় এবং সমস্ত ধর্মভীরু প্রজার মনে ভীতি ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়। সে তার অভিপ্রায় চরিতার্থে অবিচল, নিঃশঙ্ক, নিরন্তর সচেষ্ট। তার সমস্ত চক্রান্ত রাজার কাছে ধরা পড়ে গেলে রঘুপতির আট বছরের নির্বাসন দন্ড হয়। বুকের মধ্যে তার পরাজয়ের জ্বালা হু হু করে জ্বলতে থাকে। তার শিষ্যের প্রতি অগাধ বিশ্বাস - শ্রাবণের শেষরাতে রাজরক্ত এনে দেবে।

সে বিশ্বাস তার অটুট। মন্দিরের বাইরে সর্বনাশের ঝড় উঠেছে। হয় রাজা, না হয় রঘুপতি এ ঝড়ে শুকনো পাতার মত উড়ে যাবে। কিন্তু না, বিশ্বাসের পাথরে খোদাই রঘুপতির চোখ, ধর্মবিশ্বাসে। কিন্তু তার পুত্রতুল্য শিষ্য যখন আত্মবিসর্জন দিয়ে রক্ত এনে দিয়েছে তখনই তার চৈতন্য ফিরে এসেছে। পাষাণস্তূপ দেবীকে জলে নিক্ষেপ করে মানবী দেবী অপর্ণার হাত ধরে মন্দির ছেড়েছে।


জয়সিংহের চারিত্রিক অন্তর্নিহিত দুর্বলতাই তার জীবনের শোচনীয় পরিণামের জন্য দায়ী। সে দুর্বলতা এসেছে তার মনুষ্যত্ব হতে, তার পবিত্র নিষ্কলঙ্ক হৃদয় হতে। জয়সিংহ উদার, প্রেমিক, কবি ও দার্শনিক। তার মধ্যে কৃত্রিমতা নেই, নেই স্বার্থবুদ্ধি। আজন্ম শিক্ষা ও সংস্কারের বশে, মা মন্দিরে আছে এবং রক্তবলি কামনা করে, এটাই তার দৃঢ়বিশ্বাস। কিন্তু অপর্ণার কাছ থেকে সে যে প্রেম ও মানবতার সন্ধান পেল, তাতে পূর্বের সংস্কার তার মিথ্যে হয়ে গেল।

তদুপরি রাজা যখন তাকে দেখিয়ে দেয় যে রঘুপতি মিথ্যের আশ্রয় নিচ্ছে— তখন মানবতার প্রতীক রাজাকে সে রক্ষায় প্রতিজ্ঞ হলো। প্রথাধর্ম ও দেবীতে বিশ্বাস তার ভাঙলেও দায়বোধের কারণে আবাল্য লালিত গুরু রঘুপত্তির সঙ্গেকার সম্পর্ক সে বিস্তৃত হতে পারে নি। ফলে গুরুকে দেয়া প্রতিশ্রুতির সে বাস্তবায়ন ঘটায় আত্মহননের মধ্য দিয়ে। তার আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে সে গুরুকে বোঝাতে চেয়েছে হিংসার চেয়ে প্রেম বড়। স্নেহ কত গভীর এবং প্রাণের কী মূল্য!


জয়সিংহ তার বুকের রক্তে দেবীর পা ধুয়ে দিয়ে বলেছে- এই যেন শেষ রক্ত হয়। কিন্তু সে স্থির বিশ্বাস নিয়ে মরতে পারে নি। শান্তি, তৃপ্তি, অম্লান, অচল দীপ্তি নিয়ে জয়সিংহ মরতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মরেছে। তার মৃত্যুতে রক্তদান বন্ধ হবে কি না, সে বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়ে মরতে পারেনি,আর নাটকটির করুণ ট্র্যাজেডি এখানেই।

জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতি বুঝতে পেরেছে প্রাণের মায়া এবং অপর্ণার মন্তানতুল্য ছাগশিশু হারানোর ব্যথা। রাক্ষসী দেবী তার শিষ্যতুল্য সন্তানটিকে পর্যন্ত লোলজিহ্বা প্রসারিত করে গ্রাস করেছে। তাই দেবীমূর্তিকে গোমতীর জলে নিক্ষেপ করে সে অপর্ণার হাত ধরে মন্দির ছেড়েছে।


জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের বেদনা বহন করতে হয়েছে রঘুপতিকে। রঘুপতির ট্র্যাজেডির বীজ তারই অন্তরে নিহিত ছিল, তা হচ্ছে জয়সিংহকে পুত্রাধিক স্নেহ। যে স্নেহ-প্রেমকে বহির্জীবনে সে দলিত মথিত করেছে, সে স্নেহ-প্রেমই তার অন্তরের এক কোণে ছিল অবরুদ্ধ। সেই আচ্ছন্ন স্নেহ প্রচণ্ড বেগে আত্মপ্রকাশ করে তাকে বেদনায় প্লাবিত করেছে। 


তার পশু অংশ বাইরে রাজশক্তির সাথে সংগ্রাম করছিল, কিন্তু সে চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হল নিজেরই দেব অংশের হাতে। নিদারুণ বেদনার মধ্য দিয়ে সে স্নেহ-প্রেমের মর্যাদা বুঝতে সক্ষম হল, তার নবজন্ম হল। অহংকার, অভিমান, দেবতা, ব্রাহ্মণ সব গেল, তবুও জয়সিংহকে ফিরে পাওয়া গেল না। কিন্তু শিষ্য বা পুত্র জয়সিংহের মৃত্যু গুরু বা পিতা রঘুপতির অন্তরাত্মাকে বাঁচাল।


রঘুপভিন্ন এই যে আকস্মিক পরিবর্তন, তাতে অস্বাভাবিকতা নেই। প্রচণ্ড শক্তিশালী একমূখী হৃদয়াবেগের এই যে পরিবর্তন তা রঘুপতির জীবনের ঘনীভূত ট্র্যাজেডিকে অনেকটা হালকা করেছে। তার প্রাণাধিক প্রিয় জয়সিংহ যে তার প্রচণ্ড অহংকারের বলি, এই মর্মান্তিক চেতনার মধ্যেই তার জীবনের ট্র্যাজেডি নিহিত।

আমরণ এই বেদনার তুষানল তাকে দগ্ধ করতে থাকবে, এরূপ কল্পনার সুযোগ দিলে নাটকটি ট্র্যাজিক হত। কিন্তু তা না হয়ে জয়সিংহের মৃত্যু তার মধ্যেকার কুসংস্কার, হিংসা দূর করে জীবনের প্রকৃত রূপের সন্ধান দিয়েছে। মুরু, পঙ্গু, অন্ধ, বধির জড় পাষাণের মধ্যে সত্যিকারের দেবী নেই বলে তাকে তালে নিক্ষেপ করে, অপর্ণাকে অমৃতময়ী প্রভাষ দেবী জ্ঞান করে মন্দির ছেড়েছে।


নাট্যকার মূলত তাঁর 'বিসর্জন' নাটকে ঘটনা বা চরিত্রের ওপর বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বরং প্রথাধর্মের ওপর মানবধর্মের বিজয় দেখাতেই বিশেষ প্রযত্নবান ছিলেন। ফলে 'বিসর্জন' রঘুপতির মানস বদল ঘটিয়ে নাট্যকারের অভীষ্ট পূরণ করেছে। ফলে বিসর্জনের সফল ট্র্যাজেডির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিসর্জন হয়ে উঠেছে আধুনিক ট্র্যাজেডি। এমানদন্ডে 'বিসর্জন' নাটকটিকে একটি সার্থক ট্র্যাজেডিও বলা যেতে পারে পাঠক মনে করেন।


বিসর্জন নাটক।বিসর্জন নাটকের দ্বন্দ্ব।বিসর্জন নাটকের নায়ক কে।বিসর্জন নাটক প্রশ্ন উত্তর। বিসর্জন নাটকের জয়সিংহ চরিত্র।বিসর্জন নাটকের বিষয়বস্তু।বিসর্জন নাটকের সারাংশ।বিসর্জন নাটকের ভাষা ও সংলাপ।বিসর্জন নাটকের নামকরণের সার্থকতা।বিসর্জন নাটকরে রঘুপতি চরিত্র।বিসর্জন নাটকরে চরিত্র বিশ্লেষণ।বিসর্জন নাটকের শিল্পমূল্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ