বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।বিষাদসিন্ধু উপন্যাস বিশ্লেষণ
ভূমিকা: বাংলা মুসলিম সাহিত্যের গতিধারায় মীর মশাররফ হোসনের নাম সর্বত্র প্রণিধানযোগ্য।বাংলা সাহিত্যে তিনি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন,তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধুর কারণে।এ উপন্যাসে তাঁর নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটির গঠনশৈলী তাঁর সচেতন শিল্পী মনের পরিচয় বহন করে।'ইমাম হাসান-হোসেনকে হত্যা'-এই ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি নানাবিধ উপকাহিনী অনৈতিহাসিক ও লেখকের স্বকল্পিত চরিত্র এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনার সংমিশ্রণে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে, একটি ইতিহাস আশ্রিত রোমান্স উপন্যাস।উপন্যাসটির বিষয়-বৈচিত্র্যে,চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে কথক গভীর জীবনবোধের পরিচয় দিয়েছেন।ইতিহাস ও ধর্মীয় আবেগ এ গ্রন্থ রচনায় প্রেরণা সৃষ্টি করলেও আধুনিক শিল্পীর সুনিপণ শিল্পকর্ম,বিষয় গৌরব,কাহিনী, ভাষা-সংলাপ ও চরিত্র চিত্রণে জীবনবোধের অনন্য শিল্পকর্ম হয়ে উঠেছে।
কাহিনি বিন্যাস: আলচ্য উপন্যাসের ঘটনাংশ আদি-মধ্য-অন্ত্যযুক্ত সমগ্র এবং প্লটটি সরল রৈখিক।তাছাড়া বিন্যাসরীতি প্রচলিত উপন্যাসের ধারানুবর্তী।সর্বমোট তিনটি পর্বে বিন্যস্ত -এ উপন্যাসের কাহিনি কারবালার বিষাদময় ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে গড়ে উঠলেও, জয়নাবের প্রতি এজিদের রূপতৃষ্ণা, প্রণযাসক্তি, ব্যর্থতা এবং তার পরিণাম, উপন্যাসের কাহিনির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
তিন পর্বে বিভক্ত বিষাদ সিন্ধুর মহরম পর্বে বর্ণিত হয়েছে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়া পুত্র এজিদের প্রণয়াসক্তি ব্যর্থতা এবং তার পরিণাম। উদ্ধারপর্বে আছে বিপন্ন হােসেন পরিবারের অস্তিত্বরক্ষা এবং ক্রোধান্ধ দুর্জয় বীর হানিফার প্রতিশোধ গ্রহণের বিবরণ। শেষখণ্ড এজিদবধ পর্বে হানিফার এজিদ হত্যার প্রচেষ্টা,এজিদের ভূ-গর্ভস্থ গুপ্ত কক্ষে পলায়ন ও জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নারকীয় কষ্টভোগ, দৈব নির্দেশে বহু প্রাণক্ষয়কারী হানিফার প্রাকৃতিক বন্দিত্ব এবং হোসেন বংশধর জয়নাল আবেদীনের রাজ্য লাভের কাহিনি বিবৃত হয়েছে।উপসংহারে লেখক সত্যের জয় ও পাপের পরিণামফল ভোগের অবশ্যম্ভাবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
এই ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে লেখক একটা বিশেষ সময়ে বা কালকে যেমন তিনি ধারণ করেছেন পাশাপাশি কাহিনীকে বেগবান করার জন্য লেখক অনেক উপকাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন। উপকাহিনীতে যে চরিত্র গুলো এসেছে সেগুলো উপন্যাসের মূল কাহিনী কে কখনো কখনো বেগবান করেছে আবার কখনো কখনো বাধাগ্রস্থ করেছে।অজস্র উপকাহিনীর ফলে উপন্যাসের কাহিনী কখনো কখনো শিথিল হয়ে উঠেছে।কিন্তু মীর মশাররফ হোসেন যেহেতু একজন শিল্পী, একজন ঔপন্যাসিক কাজেই তিনি ইতিহাসের সাথে কল্পনাকে মিলিয়ে কিছু অতিলৌকিক, অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন,এ কারণে কাহিনীতে শিথিলতা এবং কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যায়।
চরিত্র চিত্রণ: চরিত্র ব্যক্তির জীবনবোধের পূর্ণায়ত রূপ।উপন্যাসে লেখক চরিত্র সৃষ্টি করেন ঘটনাংশ কে তুলে ধরার নিরিখে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের পাশাপাশি মধ্যবর্তী ও পরিপ্রেক্ষিত চরিত্র উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণে অনন্যভূমিকা পালন করে।লেখক বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসটিতে মানব চরিত্রগুলোর প্রকৃত স্বরূপই শুধু উন্মোচন করেন নি,তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, চিন্তা,দোলাচলতা সমস্ত কিছুই নিখুঁত ভাবে উন্মোচন করেছেন।উপন্যাসের চরিত্র উপন্যাসটির চরিত্রগুলোকে দুটি বিশেষ শ্রেণীতে আলাদা করা যায়। যাদের একশ্রেণীর চরিত্রগুলোতে শুধু ভালো আর ভালো গুণ দেখানো হয়েছে। এই দলভুক্ত হাসান হোসেন ও তার পরিবার এবং অন্য শ্রেণির চরিত্রগুলো শুধু খারাপ আর খারাপ করে দেখানো হয়েছে এই দলভুক্ত এজিদ সীমার । যা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ রক্ত মাংসের মানব কখনই একেবারে খারাপ কিংবা একেবারেই ভালো এরকম খুঁজে পাওয়া বিরল।। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে উপন্যাসটিতে একমাত্র এজিদ চরিত্রটি রক্ত-মাংস চরিত্র হিসেবে রক্ষিত থেকেছে। অর্থাৎ ভালো-মন্দের মিশ্রণে মানবীয় গুনে এজিদ চরিত্রটি সার্থক ও প্রবল হয়ে উঠেছে।
বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের এজিদ চরিত্রঃ এ উপন্যাসের প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র এজিদ এবং এজিদই উপন্যাসের নায়ক হয়ে উঠেছে। ঔপন্যাসিক যেন তার লেখনী সত্ত্বার সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে এ চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন। সেজন্যই বোধ হয় এজিদ চরিত্রের মত এত প্রাণবন্ত আর তেজস্বী চরিত্র উপন্যাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী বলেন,"গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট এবং প্রদীপ্ত চরিত্র এজিদের। তার চিন্তায়-আচরণে,আবেগে-অভিব্যক্তিতে এমন একটা দৃঢ় ধারণা আছে যে অন্যান্য চরিত্র তার পাশে নিতান্ত মর্যাদাহীন বলে মনে হয়। নীতিবিদের দৃষ্টিতে এজিদের ক্রিয়াকর্ম যত গর্জিত অভিশপ্ত বিবেচিত হোক না কেন, চরিত্র বিচারের সাহিত্যিক মানদণ্ডে এজিদের মত প্রাণময় পূর্ণায়রব পুরুষ সমগ্র উপন্যাসে দ্বিতীয়টি নেই।"
বিষাদ সিন্ধুর এজিদের নির্মিত রুপ যেন ইতিহাস-পুঁথিতে থাকা এজিদকে ছাপিয়ে গেছে। বহুমাত্রিক ভিন্নতায় লেখক ইতিহাস কিংবা ধর্মীয় পুঁথিতে থাকা এজিদকে নতুন রূপে সৃষ্টি করে শিল্প সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। শিল্পীর হাতে নব্যসৃষ্ট এই চরিত্রটি মানবীয় আবেগ-অনুভূতি আর নানা দোষে-গুণে সমৃদ্ধ সংবেদনশীল। এজিদ চরিত্রটি রক্তমাংসে গড়া অমিত শক্তিধর। লেখক এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এজিদ চরিত্রটির অভিনবত্ব দান এবং এটি সার্থকভাবে শিল্পরূপ পেয়েছেও বটে। এজিদ চরিত্রটির মধ্যে তিনি মধ্যযুগীয় ধর্মচেতনার স্থলে মানব মহিমার জয়গান করেছেন চরিত্রটির মধ্যে আমরা যুগ মানুষের আত্মার মুক্তির পথ খুঁজে পাই। বিষাদ সিন্ধুর প্রথম থেকে শেষ অবধি এজিদের প্রানোদীপ্ত ও সতেজ উপস্থিতি এবং মর্মান্তিক পরিণতি পাঠকদের চিত্ত আলোড়িত ও অভিভূত করে।
এজিদ চরিত্রে নিষ্ঠুরতা অন্যতম একটি দিক।উপন্যাসের কিছু কিছু দৃশ্যে এজিদের নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেয়েছে। ঔপন্যাসিকের ভাষ্যমতে,"এজিদ হাসিতে হাসিতে বলিলেন... তোমার জীবন আমার হস্তে। মনে করিলে মুহূর্তের মধ্যে তোমাকে খন্ড খন্ড করিয়া শৃগাল কুকুরের উদরে দিতে পারি।"(উদ্ধার পর্ব/তৃতীয় প্রবাহ,পৃ:১৪৭)
অন্যদিকে এজিদ যথার্থ প্রেমিক, তারমধ্যে কামুকতা নেই। ক্ষমতার জোরে জয়নাবকে বন্দি করে তার দরবারে এনেও অন্তরে লালিত ক্ষোভ বেদনা সত্ত্বেও কাপুরুষতার পৈশাচিকতার উন্মত্ত হয়ে ওঠে নি বরং এতকিছুর পরেও সে জয়নাবের হৃদয় জয় করতে প্রয়াসী। তার রূপজমোহে কামনার হলাহল থাকলেও শঠতা নীচতা ছিলনা জয়নাবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত তার প্রেম ও সৌন্দর্যবোধ পাঠককে অনেকখানি মুগ্ধ করে।এই দুইটি ভাবের ধারক চরিত্রটি কাহিনীর নিয়ন্ত্রকশক্তি হিসেবেও উপস্থিত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায় শিল্পী মোশারফ হোসেন এই চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেছেন।
জায়েদা: অন্যদিকে এই উপন্যাসে নারী চরিত্রের মধ্যে সবচাইতে উজ্জ্বল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং জীবন্ত নারী চরিত্র হলো জায়েদা। দক্ষ শিল্পীর মতো ঔপন্যাসিক জায়েদা চরিত্রের হৃদয়কে উন্মোচন করেছেন, উদঘাটিত করেছেন তার মনের সমস্ত নীচতা, দীনতা ও জিঘাংসা। এই চরিত্রের মাধ্যমে লেখক একজন নারীর ভিতরকার সমস্ত হীনতা নীচতাকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। সপত্নীবাদের ফলে তার ভিতরে যে ঈর্ষা তৈরি হয়েছে, সে কারণেই সে স্বামী হন্তারক হতে বাধ্য হয়েছে। কারণ একজন স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্ব কর্তব্যবোধের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয় এবং সীমাবদ্ধতার সূত্র উন্মোচিত হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সেই স্ত্রীর মনে এই ধরনের জটিলতা কাজ করে। জাহিদা যে কাজটি করেছে নিন্দনীয় হলেও নারী হিসেবে এবং নারীর মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় স্বাভাবিক হিসেবেই করেছে।
জয়নাব ও মায়মুনা: এই উপন্যাসে জয়নাব এবং মাইমুনা রক্তমাংসময় চরিত্র। সহনশীলতা,দৃঢ়চিত্ত, স্বামীর প্রতি অবিচল আস্থা জয়নাব চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করেছে। অপরদিকে মায়মুনা পাষণ্ড চরিত্র এবং লোভীও। প্রকৃতপক্ষে মায়মুনা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই উপন্যাসে আগমন ঘটেছে। সিমার সাহসী বীর কিন্তু মায়মুনার মতোই অর্থলোভী,অর্থ তার জীবনের মূলমন্ত্র। এছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত চরিত্র আছে তারাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
দৃষ্টিকোণ: এ উপন্যাসে মূলত সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ লেখক নিজেই এই উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তবে কোনো কোনো স্থানে চরিত্রের প্রেক্ষণবিন্দু চরিত্রে দৃষ্টিকোণও ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে এজিদ জয়নাব হাসান জায়েদা সীমার এদের প্রেক্ষণবিন্দু বা দৃষ্টিকোণ তিনি ব্যবহার করেছেন। ফলে নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ এর পরিবর্তে বহুমুখী দৃষ্টিকোণ উপন্যাসে পরিলক্ষিত হয়।মায়মুনার দৃষ্টিকোণে "হাসান আমার কে? হাসানকে মারিতে আর আমার দুঃখ কী? আর ইহাও এক কথা,আমি নিজে মারিব না, আমি কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমার পাপ কি?মনে মনে এইরূপ আন্দোলন করিতে করিতে মায়মুনা শয়ন করিল।(12/1)
পরিচর্যারীতি উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যারীতি উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে বর্ণনাধর্মী পরিচর্যারীতি পাশাপাশি গীতময়তা, বিশ্লেষণধর্মী, নাট্যিক পরিচর্যারীতি ব্যবহার করেছেন।
আক্কাস বলিলেন, “সে কী! আবদুল জাব্বার কী মরিয়াছেন এ
মােসলেম বলিলেন, “না, আবদুল জাব্বার মরে নাই! জয়নাবকে তালাক দিয়াছে।”
আক্কাস বলিলেন, “আহা! এমন সুন্দরী স্ত্রীকে কী দোষে পরিত্যাগ করিল?
মােসলেম বলিল, “ভাই! ঈশ্বরের কার্য মনুষ্যবুদ্ধির অগােচর'
(৩/১)
উপন্যাস যেহেতু বর্ণনাত্মক শিল্পকর্ম তাই এর ভাষা ও সংলাপ অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস ভাষা ও সংলাপ ব্যবহারে মীর মোশাররফের স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় গ্রন্থটির ভাষা সাধু গদ্যে রচিত এবং তৎসম শব্দবহুল। এছাড়া পাঠক কে ধরে রাখবার মতো ভাষার মধ্যে প্রবাহমানতা ,প্রদীপ্ত এবং বহমানতা লক্ষণীয়। অতুলনীয় বাক কারুকার্যে উপন্যাসের ভাষা হয়ে উঠেছে আবেগের স্পন্দে দোলায়িত, কাব্যিক দ্যোতনায় সমন্বিত, সাংগেতিক মাধুর্য মন্ডিত এবং নাটকীয় রস সমৃদ্ধ। উপন্যাসে আবেগের স্পন্দন আছে বহু স্থানে। যেমন-"হায়! হায়! এ আবার কী! উহ কী ভয়ানক ব্যপার! উহ কী নিদারুণ কথা!" ১/১৪
আবার কখনো কখনো ভাষাকে সংকেতায়ন করতে ঔপন্যাসিক কাব্যিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। কারণ মীর মশাররফ শুধুমাত্র গদ্য রচয়িতা ছিলেন না একই সাথে কবিও ছিলেন তাই স্বাভাবিক ভাবেই কবিসত্তার প্রভাব উপন্যাসের ভাষায় দেখা যায়। যেমন
"রজনী দ্বিপ্রহর। তিথির পরিভাগে বিধুর অনুদয়, কিন্তু আকাশ নক্ষত্রমালায় পরিশোভিত" ৩/২৭
ভাষাঃ এছাড়াও ভাষার মধ্যে তথ্যধর্মী, বিশ্লেষণাত্মক গদ্য,গীতিময় পরিচর্যার ব্যবহার লক্ষনীয়। বিষয়কে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য এই ধরনের পদ্ধতি লেখক গদ্যে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ বিষয়কে সার্বজনীন রূপ এবং আরো বেশি বাস্তবসম্মত করার জন্য তিনি এই পদ্ধতিতে গদ্য নির্মাণ করেছেন। যেমন:'সীমারের ধবল বিশাল বক্ষে লোমের চিহ্নমাত্র নাই, মুখাকৃতি দেখিলেই নির্দয় পাষাণ-হৃদয় বলিয়া বোধ হইত – দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত – সীমারের চরিত্রকে বোঝানোর জন্যই তিনি এই বিশ্লেষণাত্মক গদ্যের ব্যবহার করেছেন।
শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও লেখক অত্যন্ত সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একদিকে যেমন আরবি-ফারসির ব্যবহার পরিহার করেছেন অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে অধিক পরিমাণে ব্যবহার করেছেন সংস্কৃত শব্দ।
শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি লেখক বাক্য ব্যবহারেও নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। স্বল্প দৈর্ঘ্য বাক্য যেমন ব্যবহারের করেছেন, পাশাপাশি দীর্ঘ বাক্যও তিনি ব্যবহার করেছেন। দীর্ঘ বাক্য গঠন করতে গিয়ে বাক্যকে ছোট ছোট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে বিভাজন করেছেন এবং বাক্যের মধ্যে প্রবহমানতা সৃষ্টি করেছেন। যেমন:
"অশ্ব ছুটিল। হোসেনের অশ্ব বিকট চিৎকার করিতে করিতে সীমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। আবদুল্লাহ জেয়াদ, অলীদ প্রভৃতি অলক্ষ্যে অবিশ্রান্ত শরনিক্ষেপ করিতে লাগিল। সুতীক্ষ্ণ তীর অশ্বশরীর ভেদ করিয়া পার হইল না, কিন্তু শোণিতের ধারা ছুটিল।কে বলে পশুহৃদ্য নাই ২/১
এ গ্রন্থে বিদ্যসাগরী
বঙ্কিমী গদ্যরীতিকে আত্মীকৃত করে গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন স্বীয় শিল্পীসত্তা নিয়ে
আত্মনির্ভরশীলভাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
বিষাদসিন্ধু উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা
কিন্তু গ্রন্থটিতে কোথাও এলায়িত বর্ণনা, ভাষা ও প্রয়োজনের অলঙ্কার ব্যবহারে এর গদ্যকে জটিল করে তোলে। যেমন: উদ্ধার পূর্বে “একবিংশ প্রবাহের প্রথম অনুচ্ছেদে 'দুরাশাকে আটটি পৃথক উপমানের সাদৃশ্যে দেখানো হয়েছে : "হতাশনের দাহন আশা, ধরণীর জলশোষণ আশা, ভিথারীর অর্থলোভ আশা, চক্ষুর দর্শন আশা, গাভীর তৃণভক্ষণ আশা, ধনীর ধন-বৃদ্ধির আশা, প্রেমিকের প্রেমের আশা, সম্রাটের রাজ্যবিস্তার আশার যেমন নিবৃত্তি নাই, হিংসাপূর্ণ পাপহৃদয়ে দুরাশারও তেমনি নিবৃত্তি নাই-ইতি নাই।" (২থ,পৃ. ৩৭১)
এ ধরনের আলঙ্কারিক উপস্থাপনা গদ্যে ভার হয়ে দাঁড়ায়, ধার বাড়ায় না, ঘটনার প্রবহমানতাকে
অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করে।কিন্তু সার্বিকভাবে 'বিষাদ সিন্ধু' উপন্যাসের বিষয় স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পমূল্য পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা যে সমকালীন সমাজচিত্রের বাস্তব দিক আমাদের চোখে পড়ে তা এক কথায় অনবদ্য। ইতিহাস আর লেখকের কল্পনা কাহিনি আর চরিত্রের একাত্মতা, ভাষা আর সংলাপের সুষম বণ্টন 'বিষাদ-সিন্ধু' আজও প্রাসঙ্গিক সমগ্র পাঠকসমাজে।
0 মন্তব্যসমূহ