বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে নারী চরিত্র। বিষাদসিন্ধু উপন্যাস বিশ্লেষণ।

বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে নারী চরিত্র। বিষাদসিন্ধু উপন্যাস বিশ্লেষণ।


চরিত্র ব্যক্তির জীবনবোধের পূর্ণায়ত রূপ। বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসে লেখক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ঘটনাংশকে তুলে ধরার নিরিখে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের পাশাপাশি মধ্যবর্তী ও পরিপ্রেক্ষিত চরিত্র উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ-সিন্ধুতে মানব চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপই শুধু উন্মোচন করেননি,

বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।


তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দ্বিধা-দোলাচলতা সবকিছু নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেছেন।আলচ্য উপন্যাসে নারী চরিত্রের মধ্যে জায়েদা এবং জয়নাব চরিত্র সমান্তরালভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চরিত্র দুটি উপন্যাসের কাহিনী কে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একদিকে প্রেমে-ঈর্ষা জায়েদা চরিত্রটিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, অন্যদিকে স্বামীর প্রতি দৃঢ় ভক্তি সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত জয়নাব চরিত্রটিও উপন্যাসে আরেকটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।






উপন্যাসের অন্যতম একটি প্রধান চরিত্র জায়েদা, সে চিন্তা চেতনায় এজিদের সমধর্মী, এজিত যেমন একমুখী, জেদি, জিগাংসা প্রবন, এসমস্ত গুণ জাএেদা চরিত্রেও ঔপন্যাসিক আরোপ করেছেন।এজিদ যেমন রূপজতোহ, হিংসাত্মক কার্যকলাপের লিপ্ত হয়েছে, তেমনি জায়েদাও তার স্বামীর প্রেমানুভব দাবি পূরণ করতে গিয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি। এজিদের চরিত্রে তার কৃতকর্মের জন্য উপন্যাসের শেষে সামান্যতম হলেও অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায় কিন্তু জায়েদা চরিত্রে অনুশোচনা লেশমাত্র দেখা যায় না।


জায়েদা চরিত্র নির্মাণে ঔপন্যাসিক, চরিত্রটিকে বিভিন্নভাবে বা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন। জায়েদার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা,ইমাম হাসান কে নিবিড় ভাবে পাওয়ার জন্য প্রেমাকর্ষণ, প্রেমানুভব এটি যেমন উপন্যাসের চিত্রিত হয়েছে এবং ইমাম হাসান জাএদাকেই যেন কেবল ভালোবাসে এই চিন্তাধারা থেকে সে মায়মুনার পরামর্শে সিধান্ত নেয়,জয়নাবকে সে দূরে সরিয়ে দিবে।এর জন্য মায়মুনা তাকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করতে থাকে এবং একটা পর্যায়ে জায়েদা জিঘাংসা মূলক কর্মকান্ড উদ্যত হয়। জায়েদা হাসানকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন এবং হাসনেবানুর নিকট থেকে যথেষ্ট স্নেহ লাভ করেছে কিন্তু জয়নাব আসার পর থেকেই জায়েদার মনে পরিবর্তন শুরু হয়,তার মধ্যে সপত্নীবাদ,ঈর্ষা,বিদ্বেষ জাগ্রত হয়।জায়েদা মায়মুনার কথপোকথনে:


"জায়েদা বাঁচিয়া থাকিতে স্বামী ভাগ করিয়া লইবে না" অর্থাৎ সে স্বামীকে ভাগ করে নিতে পারবে না এই মনোভাব থেকেই সে মায়মুনার পরামর্শে হাসানকে বিষ প্রয়োগের মত হীন কাজে তৎপর হয়েছে। এভাবে লেখক তার ব্যক্তিজীবনের সপত্নী বাদের ধারণা উচ্চকিত সফলতায় উপস্থিত করেছেন। মূলত স্বামী প্রেমে কাতর জায়েদার হৃদয় যখন ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে পারেনি,তখনই সে এরকম হীন কাজ করতে তৎপর হয়েছে ।


জায়েদা চরিত্রে স্বামী বঞ্চিত এক ব্যথিত নারী-হৃদয়ের করুণ আর্তি এবং  জায়েদা যে হাসানকে খুব ভালোবাসতেন উপন্যাসের বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্য করা যায়,সেই ভালবাসার বলী শেষ পর্যন্ত ইমাম হাসানের উপরেই পড়লো,যা উপন্যাসের অন্যতম একটি ট্র্যাজিক অধ্যয় বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।জায়েদা স্বামী প্রণয়িনী ও স্বামী ভক্ত নারী,তাই মায়মুনা সপত্নীবাদের বিষবাষ্প ঢেলে  দিলেও, সে শুরুতে হাসানকে বিষ প্রয়োগের সম্মতি দেয় নি এবং কঠোর হলেও স্বামীর প্রতি  ভালোবাসার কমতি ছিল না। তাই সে বলেছে :

"এ দুঃখে যদি মরিয়াও যায়,আরও শতশত প্রকার দুঃখ যদি ভোগ করি,সপত্নীবিষম বিষে যদি আরও জর্জরিত হয়,পরমায়ুর শেষ পর্যন্ত দুঃখের সীমা না হয় তথাপি উহা পারিব না।"


অর্থাৎ জায়েদার স্বামীর প্রতি যে ভালোবাসা, এই একনিষ্ঠ ভালোবাসায় তাকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য করেছে স্বামীকে হত্যা করতে। সে চেয়েছে জয়নাবকে স্বামীর সঙ্গ পেতে দিবে না, আবার সে নিজেও পাচ্ছে না, ফলে এ আক্রোশটা পড়েছে হাসানর উপরে। স্বামীর প্রতি একমুখী ভালবাসা বা প্রেম এবং হাসান জয়নাবকে বেশিমাত্রায় ভালোবাসা নিবেদন করেছে, এটাই জায়েদা সহ্য করতে পারেনি এবং জায়েদাকে অসুখী করতেই সে এমন কাজ করতে উদ্যত হয়েছে।জায়েদার স্বগতোক্তিতে: "তোকে কাঁদাতেই এ কাজ করিয়াছি,কেবল তোর জন্যই এই স্বামীগৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিলাম।"


উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে জায়েদা চরিত্রকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার চরিত্রে একদিকে সপত্নীবাদ , লোভ,ঈর্ষা এবং অন্যদিকে প্রেম এই দুই ভাবের সংঘর্ষ উপন্যাসে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ স্বামীর প্রতি গভীর আকর্ষণ প্রীতি এবং জয়নবের প্রতি ঈর্ষা ও পরবর্তীতে রাজ্য ভোগের লোভ এই সমস্ত ভাবনা তার ভিতরে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ফলে জায়েদা চরিত্রটি আরো বেশি বেগবান হয়ে উঠেছে। ঔপন্যাসিক অত্যন্ত সুচারুভাবে জায়েদা হৃদয়েরে টানাপোড়ন উপন্যাসের চিত্রিত করেছেন। লেখকের ভাষ্যে


 " একদিকে রাজ্য ভোগের লোভ, অপরদিকে স্বামীর ক্রমে ক্রমে ক্রমে তুলনা করিতে লাগিলেন, কতবার পরিবর্তন করিলেন দুরাশা পাষাণ ভাঙ্গিয়া, তুলাদন্ড মনোমতো ঠিক করিয়া, অসীম দুঃখ ভার চাপিয়ে দিলেন তথাপি স্বামীর প্রাণের দিকেই বেশি ভারী হইল, কিন্তু জয়নাবের নাম মনে পড়িবা মাত্রই পরিমাণ দন্ড যেদিকে স্বামীর প্রাণ সেদিকে একেবারে লঘু হইয়া উচ্চে উঠিল " মহররম পর্ব

অর্থাৎ ঈর্ষা ও প্রেমের টানাপোড়নে শেষ পর্যন্ত চরিত্রটি অমীমাংসিত চরিত্রে পরিণত হয়েছে। সে শেষ পর্যন্ত কিছুই পেল না বরং নিজের কাছেই পরাজিত হল।


উপন্যাসে একাধিক ট্রাজিক চরিত্র লক্ষ্য করা যায়, এজিদের মতো জায়েদা এক অর্থ ট্রাজিক চরিত্র। নারী চরিত্রের মধ্যে জাহিদের ট্রাজেডি সবচেয়ে মর্মস্পর্শী এবং হৃদয়বিদারক। জায়েদা ঐশ্বর্য ও প্রেমে জীবনকে উপভোগ করতে এবং সুখী হতে চেয়েছিল।রাজরানী হবার বাসনা ঈর্ষাকাতরতা প্রভৃতির অন্বেষণে তাকে দেশে অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু তার এই ভাবনা তৎপরতা তাকে সুখী করতে পারেনি বরং তার নিশংস নির্মম কাজের শাস্তি স্বরূপ এদের হাতেই জীবন দিতে হয়েছে। মীর মশাররফ হোসেন আধুনিক ঔপন্যাসিকের মতোই জায়েদা চরিত্রকে তুলে ধরেছেন এবং চরিত্রটির বিকাশ ঘটিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে ।নারী চরিত্র গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ও জীবন্ত চরিত্র হল জায়েদা। তার সমস্ত নীচতা ,হীনতা ,জিঘাংসা ,লোভ  ঈর্ষা সমস্ত কিছুকেই ঔপন্যাসিক সার্থকভাবে উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন।


অন্যদিকে জয়নাব একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে হলেও, চরিত্রটির ভিতরে কোন অন্তর্দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায় না বরং স্বামীর প্রতি দৃঢ় ভক্তি, সাদামাটা জীবন অভ্যস্ত জয়নাব চরিত্রটি উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।জয়নাব 'বিষাদ-সিন্ধু'তে বিনাশী সমর সংঘাতের মূল কারণ সন্দেহ নেই; তাকে কেন্দ্র করেই 'বিষাদ-সিন্ধুর সমস্ত ঘটনার আয়োজন। এজিদ ও হাসান হোসেনের সংঘর্ষের মূল কারণ জয়নাব। জয়নাব প্রথম স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে দ্বিতীয়বার পরিণীতা হয় ইমাম হাসানের সঙ্গে। এজিদের জয়নাব-লাভের উদ্দেশ্যে সমস্ত আয়োজন ও ধ্বংস অনিবার্য হয়।


এভাবে জয়নাব উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করল, কাজেই জয়নাব চরিত্রও উপন্যাসের সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এজিদের কারাগারে যখন সে বন্দি হল তখন সে অনুধাবন করতে সক্ষম হলে,সমস্ত ঘটনা মূলে আসলে সেই দায়ী। এক্ষেত্রে জয়নাব চরিত্রের সাথে মধুসূদনের সীতা চরিত্রের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে সীতাচরিত্রের সাদৃশ্যে জয়নাবের দীর্ঘ আত্মবিলাপ করুণ রসাত্মক ও মর্মবিদারী। জয়নাবের বিলাপের কিছু অংশ  :


হায়!কোথায় আমি জয়নাব! ...। এই হতভাগিনীই বিষাদ-সিন্ধুর মূল। জয়নাব এই *মহাপ্রলয়কাণ্ডের মূল কারণ। হায়! হায়! আমার জন্যই নূরনবী মোহাম্মদের পরিবার পরিজন প্রতি এই সাংঘাতিক অত্যাচার হায়রে! আমার স্থান কোথায়? আমি পাপীয়সী! আমি রাক্ষসী! (৩/৩)


এই আত্মবিলাপ ছাড়া জয়নাবের কিছু করার ছিল না। সে-ই সমস্ত ঘটনার মূলে অবস্থিত । নিয়তি তাকে সে পথে নিয়ে গেছে সে বিনা বিচারে, বিনা বাধায় সেখানেই চলে গেছে। জয়নাবে নায়িকা চরিত্রের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শৈল্পিক দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।


গুরুত্ব বিচারে জয়নাবকে প্রধান চরিত্র বলা গেলেও জায়েদা চরিত্রের তুলনায় জয়নাব অনেকটা নিষ্প্রভ চরিত্র।কারণ নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে জায়েদাই সবথেকে জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও রূপান্তরশীল,অন্যদিকে জয়নাব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম চিন্তা -চেতনায় অগ্রসর এবং ম্লান চরিত্র।কারণ এই চরিত্রে পরিবর্তন, রূপান্তর ঐ অর্থে ঔপন্যাসিক দেখাতে পারেন নি।


পরিশেষে বলা যায়,সহনশীলতা,দৃঢ়চিত্ত, স্বামীর প্রতি অবিচল আস্থা জয়নাব চরিত্রটিকে যেমন মহিমান্বিত করেছে।অন্যদিকে,দক্ষ শিল্পীর মতো ঔপন্যাসিক জায়েদা চরিত্রের হৃদয়কে উন্মোচন করেছেন।সম্পূর্ণ আধুনিক নারীর ছাঁচে এই চরিত্র দুটি লেখক নির্মাণ করেছেন।


বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের গঠনকৌশল।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের এজিদ চরিত্র।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের উক্তি।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের ভাষা।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের মূলভাব



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ