বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের গদ্যশৈলী। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস বিশ্লেষণ।


বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের গদ্যশৈলী। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস বিশ্লেষণ।

সাহিত্যের নান্দনিক বিচারে এবং জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিষাদ-সিন্ধু মীর মশাররফ হোসেনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় উপন্যাস।একইসাথে তিনিঁ মুসলিম বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক এবং উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গদ্য শিল্পী।বিষাদ-সিন্ধু' গ্রন্থে তার এই পরিচয় স্পষ্ট।

বাংলা গদ্যে  মশাররফ হােসেনের অবদান সম্পর্কে শ্ৰীবজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য উল্লেখ যােগ্য," বাংলা দেশে বাংলা সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের দান সম্পর্কে যদি স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা চলে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে স্থান, অন্যদিকে বিষাদ-সিন্ধু প্রণেতা মীর মশারফ হােসেনের স্থান ঠিক অনুরূপ। এদেশের মুসলমান সমাজে তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্যশিল্পী, এবং এখন পর্যন্ত তিনিই প্রধান সাহিত্যশিল্পী হইয়া আছেন।" (সাহিত্যসাধক চরিতমালা,পৃ-৪৪)


মীর মশারফ হােসেনের গদ্যরীতির আলােচনা করতে গিয়ে এই কথা আমাদের মনে রাখতে হবে-বিষাদ-সিন্ধুর গদ্যশৈলীর প্রশংসা সেকালে 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ও 'ভারতী’ মাসিকপত্রে এই গ্রন্থের আলােচনায় ভাষার প্রশংসা করা হয়েছিল।গদ্যের ভিতরে তিনি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।তিনি একদিকে যেমন সংস্কৃত-সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেছেন,তেমনি আরবি-ফারসির ব্যবহার করেছেন, তবে তা কিঞ্চিৎ পরিমাণে।আবার গীতময় গদ্যের ব্যবহার রয়েছে অসংখ্য,নাটকীয়তা,কাব্যধর্মী,তথ্যধর্মী,চিত্রধর্মী প্রভৃতি গদ্যের ব্যবহার তিনি করেছেন।এরকম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষাদ-সিন্ধুর গদ্যরীতিকে আমরা বিচার বিশ্লেষণ করতে পারি।


বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের গদ্যরীতি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ।এর মধ্যে অন্যতম কারণ, এই উপন্যাসে  লেখক তাঁর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর রেখেছেন শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে।তিনি যথা যথাসম্ভব উপন্যাসের গদ্যরীতিতে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার তুলনামূলক কম করেছেন।সেক্ষেত্রে তাঁর প্রবণতা বা ঝোঁক ছিল সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং তৎসম শব্দবহুল শব্দ তিনি যে উপন্যাসে প্রযুক্ত করেছেন, সেটি বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের গদ্য শৈলীর একটি শ্রেষ্ঠ জায়গা।








শুধু তাই নয়,লেখক বিষয় এবং চরিত্র অনুযায়ী উপন্যাসের গদ্য নির্মাণ করেছেন।উপন্যাসের বিষয় কারবালার ঐতিহাসিক বাস্তবতা, কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি এই উপন্যাসে সেই ধরণের বিষয় অনুযায়ী গদ্য তিনি রচনা করেছেন।অর্থাৎ ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়কেন্দ্রিক গদ্য তিনি যেমন ব্যবহার করেছেন,আবার কখনও কখনও তিনি নর-নারীর আবেগায়িত সংলাপও ব্যবহার করেছেন এবং এই উপন্যাসের প্রায় সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই আবেগি গদ্যের ব্যবহার।নরনারী আবেগের স্পন্দন এবং আবেগকে ছাপিয়ে এই উপন্যাসের গদ্য হয়ে উঠেছে অনেকটাই আলাদা যেমন-"হায়! হায়! এ আবার কী! উহ কী ভয়ানক ব্যপার! উহ কী নিদারুণ কথা!" ১/১৪




এখানে উপন্যাসের শুরুতেই সেই আবেগের স্পন্দন আমরা দেখতে পাই।এই আবেগের স্পন্দন আলচ্য উপন্যাসের গদ্যরীতিতে একটা বড় সাফল্য এনে দিয়েছে এবং এতে অসংখ্য আবেগায়ীতর গদ্য আছে যেমন-

"তুই দুঃখিনীর ধন! দুঃখীর হৃদয়ের ধন! অঞ্চলের নিধি! বাপ্! তোর দশা কী ঘটিল? হায়! হায়!" ৩/১


এজিদের মা যখন এই কথাটি বলছেন,এখানে তার মাতৃ হৃদয়ের আবেগ উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়েছে।অর্থাৎ গদ্যের ভিতরে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশ করে লেখক উপন্যাসের ভিতরে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছেন।


এরপর উপন্যাসের গদ্যরীতিতে কাব্যিক দ্যোতনা আমরা দেখতে পাই। প্রায় অধিকাংশ জায়গাতেই গদ্যের ভিতর কাব্যধর্মীতা আছে।যেমন-

"রজনী দ্বিপ্রহর। তিথির পরিভাগে বিধুর অনুদয়, কিন্তু আকাশ নক্ষত্রমালায় পরিশোভিত" ৩/২৭


 এই গদ্যরীতিতে পয়েটিক ডিকসন বা কাব্যিক দ্যোতনা লেখ সৃষ্টি করেছেন।কাব্যধর্মীতা গদ্যে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের ভাষা শৈলীতে গীতময়তার একটা জায়গা তিনি নির্মাণ করেছেন এবং এভাবেই ভাষার ভিতর একটা স্বচ্ছন্দতা তৈরী হয়েছে।


বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের নারী চরিত্র


নাটকীয়তা বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের গদ্যরীতিকে আরেকটি বড় শিল্প সাফল্য তৈরি করেছে।বিভিন্ন দৃশ্যে,পর্বে,প্রবাহে আমরা দেখি,চরিত্রগুলো পরষ্পর কথপোকথনরত এবং নাটকের মতো করে সেখানে চরিত্রগুলো কথা বলছে।পারস্পরিক কথনধর্মীতা আছে।আবার নাটকের মতৌ চরিত্রগুলো স্বগত সংলাপও বলছে।সেই স্বগতোক্তি উপন্যাসের কয়েক স্থানে আমরা দেখতে পাই।


চরিত্র অনুযায়ী তিনি সংলাপের ব্যবহার করেছেন।এজিদ যেমন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সম্রাট-তার সংলাপের মধ্যে সেরকম একটা ভাবগাম্ভীর্য আবহ তিনি তৈরি করেছেন। নারী চরিত্র,বিশেষ করে মাইমুনা, জায়েদা এদের সংলাপে নারীসুলভ সংলাপ তিনি গদ্যরীতিতে ব্যবহার করেছেন।ফলে ভাষার ভিতরে সহজবোধ্যতা, স্বতঃস্ফূর্ততা সহজে তৈরি করতে লেখক সক্ষম হয়েছেন।


তিনি একেবারেই সহজ স্বচ্ছন্দ ভাবে এই গদ্যরীতির ব্যবহার করেছেন।গদ্যরীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একইসাথে তাঁর যেমন স্বতঃস্ফূর্ততা প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি তাঁর ঔপন্যাসিক শিল্পসিদ্ধির জায়গাটিও সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।তাঁর অগ্রজ ঔপন্যাসিক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।অগ্রজ লেখক বিশেষ করে বঙ্কিমীয় গদ্যরীতির প্রভাব তার উপন্যাসে অনেকটাই দেখা যায়।বঙ্কিমীয় গদ্যরীতিতে যেমন সমাসবদ্ধ, সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই,মীর মশাররফ হোসনের বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসেও আমরা সমাসবদ্ধ সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই।যেমন:

'সিংহাসন,সিংহদ্বার,শশব্যস্ত' ইত্যাদি।এছাড়াও যুগ্ম শব্দের ব্যবহারও আমরা দেখতে পাই।যেমন:"ধীরে ধীরে এই কথাটি বলিয়ো" ১/১৪



এরপর আরেকটি বিষয় এই উপন্যাসে পাঠককে সম্বোধন করে কথা বলা বা সম্বোধনাত্মক কৌশল রীতি, যা বঙ্কিমীয় গদ্যরীতিতে আমরা দেখতে পাই।সেটিও ঔপন্যাসিক গদ্যরীতিতে উপন্যাসের বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করেছেন।পাঠককে সম্বোধন করে উপন্যাসে লেখক আবির্ভূত হচ্ছেন এটা উপন্যাসের গদ্যরীতির একটা বিশেষ দিক।


উপন্যাসটি সাধুভাষায় রচিত হয়েছেসাধুভাষাতে তৎসম শব্দের ব্যবহার তিনি করেছেন অধিক পরিমানে এবং যথাসম্ভব আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার পরিহার করে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন।এ সম্পর্কে সমালোচক সেলিম জাহাঙ্গীর বলেছেন,'বিষাদ-সিন্ধুতে শব্দ সংখ্যা এক লক্ষ সাতাশ হাজার অথচ এর মধ্যে দুইশর মতো ব্যবহৃত হয়েছে মুসলিম শব্দ বা আরবি শব্দ'

অর্থাৎ শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে লেখক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।'আল্লাহ,খোদা' শব্দের পরিবর্তে কখনো ঈশ্বর, কখনো পরমেশ্বর বলেছেন আবার রাজা না বলে তিনি বলেছেন নৃপতি।শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি কখনো বিপরীত শব্দ, সমার্থক শব্দ, বিভিন্ন প্রতিশব্দও ব্যবহার করেছেন।


শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি লেখক বাক্য ব্যবহারেও নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন।স্বল্প দৈর্ঘ্য বাক্য যেমন ব্যবহারের করেছেন,পাশাপাশি দীর্ঘ বাক্যও তিনি ব্যবহার করেছেন।দীর্ঘ বাক্য গঠন করতে গিয়ে বাক্যকে ছোট ছোট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে বিভাজন করেছেন এবং বাক্যের মধ্যে প্রবহমানতা সৃষ্টি করেছেন।যেমন:


"অশ্ব ছুটিল। হােসেনের অশ্ব বিকট চিৎকার করিতে করিতে সীমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ

ছুটিল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, অলীদ প্রভৃতি অলক্ষ্যে অবিশ্রান্ত শরনিক্ষেপ করিতে লাগিল। সুতীক্ষ্ণ তীর অশ্বশরীর ভেদ করিয়া পার হইল না, কিন্তু শােণিতের ধারা ছুটিল।কে বলে পশুহৃদয়ে বেদনা নাই?" ২/১

এছাড়াও বিস্ময়বোধক,প্রশ্নবোধক বাক্যও ব্যবহার করেছেন এবং জিজ্ঞাসা করেছেন।

যেমন: "একি?

    প্রহরীগণ ছোটাছুটি করে কেনো?

    কি সংবাদ!"৩/১

এছাড়াও বাক্যে অব্যয় পদের ব্যবহার তিনি করেছেন।যেমন:'বটে,কিন্তু, অথচ' ইত্যাদি।তিনি বিরামচিহ্নের ব্যবহার করেছেন খুব সচেতনভাবে।তিনি দাগি,কমা,সেমিকোলন,হাইফেন,ড্যাশ বিভিন্ন বিরাম চিহ্নদিয়ে বাক্য গঠন করেছেন,যা লেখকের গদ্যরীতির অন্যতম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলতে পারি।


বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের আরেকটি বিষয় বিশ্লেষণাত্মক গদ্যরীতি।বিষয়কে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য এই ধরনের পদ্ধতি লেখক গদ্যে ব্যবহার করেছেন।অর্থাৎ বিষয়কে সার্বজনীনভাবে রূপ দেয়ার জন্য,আরো বেশি বাস্তবসম্মত করার জন্য তিনি এই পদ্ধতিতে গদ্য নির্মাণ করেছেন।যেমন:'সীমারের ধবল বিশাল বক্ষে লোমের  চিহ্নমাত্র নাই,  মুখাকৃতি  দেখিলেই   নির্দয়   পাষাণ-হৃদয় বলিয়া বোধ হইত – দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত –'

সীমারের চরিত্রকে বোঝানোর জন্যই তিনি এই বিশ্লেষণাত্মক গদ্যের ব্যবহার করেছেন।


কিছু সুভাষিত গদ্য তিনি ব্যবহার করেছেন,যেই সুভাষিত বচনগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বোঝার জন্য কিংবা নীতি কথা বা উপদেশ সবার মাঝে ছগিয়ে দেবার জন্য এই সুভাষিত উক্তি ঔপন্যাসিক তার গদ্যে ব্যবহার করেছেন।যেমন:'ভ্রমই লোকের সর্বনাশের মূল,ভ্রমই মানুষের অমঙ্গলের কারণ" ২/১৭

অর্থাৎ ভুল মানুষকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যায় এবং অমঙ্গল ডেকে আনে।


প্রতিকী বা ঈঙ্গিত পূর্ণ গদ্যও তিনি ব্যবহার করেছেন।কখনো কখনো লেখ চরিত্রের ভিতরকার লুকানো ইচ্ছা,অভিপ্সাকে ইঙ্গিতময় ভাষার সাহায্যে প্রকাশ করেছেন।সেক্ষেত্রে ভাষাটি হয়ে উঠেছে ইঙ্গিতময়।এছাড়াও প্রবাদ-প্রবচন,উপদেশমূলক বাণী,নীতিকথা ইত্যাদির ব্যবহার তিনি গদ্য সৃষ্টিতে করেছেন।যেমন

'ভালবাসার ক্ষমতা অসীম'১/১

'যেমন কর্ম তেমন ফল' ১/১

নীতিকথার এই বহুল ব্যবহার উপন্যাসের গদ্য রীতিকে অনেকটাই আকর্ষণীয় করে তুলেছে।


আলংকারিক গদ্য রীতির ব্যবহার আলংকারিক আভিনিবেশে এই উপন্যাসকে অনেকটা মজবুত ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে এবং বিভিন্ন ধরনের অলংকার, উপমা উৎপ্রেক্ষা,অনুপ্রাস,সমাসোক্তি তিনি ব্যবহার করেছেন।বিশেষ করে বৃত্ত্যনুপ্রাসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।যেমন

'এজিদের শিরায়, শিরায়, শোণিতবিন্দুর প্রতি…'


এই বিভিন্ন ধরনের আলংকারিক শিল্প সৌন্দর্য তিনি তাঁর গদ্যে নিয়ে এসেছেন।যে কারণে গদ্যরীতিতে একটা আলংকারিক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে।বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যার ফলে উপন্যাসের গদ্য রীতিতে বৈচিত্র্যময়তা এসেছে এবং তিনি কোনো নির্দিষ্ট গদ্য রীতিতে সীমাবদ্ধ থাকেন নি,ভিন্ন ভিন্ন গদ্য রীতির অপূর্ব সম্মিলন লেখখ তার উপন্যাসে ঘটিয়েছেন।


তাই বলার অপেক্ষা রাখেনা, অনুপম গদ্যের শিল্পসাৰ্থকতায় “বিষাদ-সিন্ধু'-র অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্কিম-বিদ্যাসাগর-মধূসূদনকে মশাররফ আদর্শ হিসেবে অনুসরণ

করলেও ‘বিষাদ-সিন্ধু'-র শিল্পসার্থকতা তার স্বােপার্জিত ও মৌলিক। অরুণকুমার

মুখােপাধ্যায়ের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রানিধাণযােগ্য। তিনি বলেন :

"বিদ্যাসাগর বাংলাগদ্যের ভিত্তি নির্মাণে বন্ধন শৃঙখলার ব্যবহার করেছিলেন।...সেই

ভিত্তির উপর বঙ্কিমচন্দ্র গদ্যের শ্ৰী ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মীর মশাররফ হােসেন সেই

শ্রী-সম্পন্ন গদ্যপটভূমিতে তাঁর গদ্যরচনাকে উপস্থিত করেছিলেন। তাই তাঁর

বাক্যসজ্জায়, পদগুচ্ছের অবস্থানে, খণ্ডবাক্যসজ্জায়, উক্তিধৰ্মী বাক্যরচনায়, নিত্যসম্বন্ধী

ও পরস্পর সম্বন্ধী শব্দযুগলের ব্যবহারে বিদ্যাসাগরী গদ্যরীতি তথা বঙ্কিমী গদ্যরীতির

সফল অনুসৃতি লক্ষ্য করা যায় । এ সব ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হােসেনের কৃতিত্ব অবশ্যস্বীকার্য।" (অরুণকুমার মুখােপাধ্যায়, 'বিষাদ-সিন্ধুর গদ্যরীতি’প, ২৩)


গদ্যশিল্পী মশাররফ হােসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু'-তে সামগ্রিক বিচারে ভাষা-বৈশিষ্ট্যের

‘সর্বাধিক সিদ্ধি ও সফলতার পরিচয় মেলে এবং “বিষাদ-সিন্ধুর গদ্য মশাররফ হােসেনের গদ্যশৈলীর সার্থক নিদর্শন।


 এ গ্রন্থে বিদ্যসাগরী

বঙ্কিমী গদ্যরীতিকে আত্মীকৃত করে গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হােসেন স্বীয় শিল্পীসত্তা নিয়ে

আত্মনির্ভরশীলভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু গ্রন্থটিতে কোথাও এলায়িত বর্ণনা, ভাষা ও প্রয়োজনের  অলঙ্কার ব্যবহারে এর গদ্যকে জটিল করে তােলে। যেমন : উদ্ধার পূর্বে “একবিংশ প্রবাহের প্রথম অনুচ্ছেদে 'দুরাশাকে আটটি পৃথক উপমানের সাদৃশ্যে দেখানাে হয়েছে :

"হতাশনের দাহন আশা, ধরণীর জলশোষণ আশা, ভিখারীর অর্থলােভ আশা, চক্ষুর দর্শন

আশা, গাভীর তৃণভক্ষণ আশা, ধনীর ধন-বৃদ্ধির আশা, প্রেমিকের প্রেমের আশা, সম্রাটের

রাজ্যবিস্তার আশার যেমন নিবৃত্তি নাই, হিংসাপূর্ণ পাপহৃদয়ে দুরাশারও তেমনি নিবৃত্তি নাই-ইতি নাই।" (২খ,পৃ. ৩৭১)


এ ধরনের আলঙ্কারিক উপস্থাপনা গদ্যে ভার হয়ে দাঁড়ায়, ধার বাড়ায় না,ঘটনার প্রবহমানতাকে অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করে।। তারপরও বলতে

হয়, “বিষাদ-সিন্ধু'ই মশাররফ হােসেনের শ্রেষ্ঠ গদ্যগ্রন্থ-যার মূল আকর্ষণ লুকিয়ে আছে এর

অনন্য ভাষাসৌধ ও নৃত্যদোদুলতায়।


বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের গঠনকৌশল।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের এজিদ চরিত্র।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের সীমাবদ্ধতা।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের উক্তি।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের ভাষা।বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের মূলভাব।জায়েদা ও জয়নাব চরিত্র বিশ্লেষণ।

মায়মুনা।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ