লোককলা বা লোকসাহিত্যের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণ কর।

পাশ্চাত্য দেশে লোককলার চর্চা বেশি। এজন্য বিভিন্ন লোককলাবিদ বিভিন্নভাবে লোককলার সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত এডওয়ার্ড মারিয়া (Edward Maria) Standard Dictionary of Folklore, Mythology and Legends (1949) কোষগ্রন্থে কতগুলো সংজ্ঞার উল্লেখ করছেন। ফ্রান্সিস লি আটলি (Francis Lee Utley) একটি প্রবন্ধে সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করে কতগুলো মুখ্য শব্দ পেয়েছেন ; সেগুলো প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সংজ্ঞায় স্থান পেয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে Oral Tradition, Transmission, Survival, Communal ইত্যাদি। এরূপ শব্দভিত্তিক বিশ্লেষণ দ্বারা তিনি যা বুঝাতে চেয়েছেন তা হলো-




১.লোককলা হলো ঐতিহ্যনির্ভর ;

২.লোককলা মৌখিকভাবে বা হাতে-কলমে পুরুষানুক্রমে প্রবাহিত হয়; লোককলা উদ্বর্ত্তন মুখী;

৩.লোককলা গোষ্ঠী বা সমষ্টি মানের ফল।


লোককলার ইংরেজি প্রতিশব্দ - Folklore. Folklore শব্দের ধারণ-ক্ষমতা অনেক বিস্তৃত। ১৮৪৬ সালে উইলিয়াম জন থমস সর্ব প্রথম Folklore শব্দটি লন্ডনের 'এনথিয়াম' পত্রিকায় ব্যবহার করেন। তিনি Folk শব্দের সাথে lore শব্দটি সংযোগ ঘটান। Folk শব্দের আভিধানিক অর্থ 'People in general; people of specified class, Lore of Body of tradition. Folk এর পরিভাষা সর্বজনগাছা হয়েছে, lore শব্দের পরিভাষা নিয়ে বিতর্ক রযেছে।


লোককলার সংজ্ঞা অনেকেই অনেকভাবেই দিয়েছেন। তবে এর একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলানো যায় - "একটি সংহত সমাজের মানুষ পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে মুখে মুখে বা হাতে কলমে লব্ধ জ্ঞানের এবং অভিজ্ঞতার আলোকে ঐতিহ্যনির্ভর যা কিছু সৃষ্টি করে তাকেই লোককলা বলা হয়। "

লোককলাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' চির নতুন ' বিষয় বলে অভিহিত করেছেন : কারণ এটি অতীতের বিষয় হয়েও একটি জীবন্ত ধারা।

মার্কিন লোককলাবিদ সি.এফ. পটার ( C F Potter) বলেছেন- Folklore is a lively fossil which refuses to die. অর্থাৎ লোককলা জীবন্ত জীবাশ্ম : এর কোনো বিনাশ নেই। রুশ লোককলাবিদ ওয়াই.এম. সকোলর (Y M) বলেছেন- "Folklore is an echo of the past, and at the same time it is the vigorous voice of the present. " অর্থাৎ লোককলা অতীতের প্রতিধ্বনি এবং একই সাথে বর্তমানের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর।


আবার এল.এ হোয়াইট (Leslie A White) বলেছেন- লোককলা সামাজিক প্রক্রিয়ায় এক ব্যক্তিব; প্রজন্ম, জনগোষ্ঠী, যুগ, অঞ্চল থেকে অপর ব্যক্তি, প্ৰজন্ম, জনগোষ্ঠীর ও অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ তাদের বক্তব্য অনুসারে বলা যায় লোককলা একটি প্রাচীন মৌলিক জনজাতি বা গোষ্ঠীর মানবসম্পদ যা ঐতিহ্যগত, আবহমান এবং ক্রমপ্রসারনশীল।


আবার, পাশ্চাত্যের Folklore- এর একাধিক বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বিজ্ঞজনের কাছে এর কোনোটাই উপযুক্ত বলে গৃহিত হয়নি। বিভিন্ন পন্ডিতগন বিভিন্ন প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন - • ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ব্যবহার করছেন- লোকবিজ্ঞান' ;


ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় 'লোকযান';

• আশুতোষ ভট্টাচার্য-'লোকশ্রুতি :'

• সুকুমার সেন 'লোকচর্যা;

• মাযহারুল ইসলাম 'লোকলোর' ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন।


এছাড়া 'লোককৃতি', লোককৃষ্টি, লোকসংস্কৃতি, লোকবিদ্যা প্রভৃতি প্রতিশব্দ রয়েছে। এর কারণ হলো ফোকলোরের পরিধি অতি ব্যাপক বলেই এসব প্রতিশব্দ নিরুপন করা হয়েছে।


লোককলার বৈশিষ্ট্য -

পাশ্চাত্য পন্ডিতগন লোককলাকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। ১.বাগাশ্রিত লোককলা (Formalised folklore ) ২.বস্তুগত লোককলা (Material folklore )


ক.বাগাশ্রিত লোককলা  - লোকসাহিত্যের যাবতীয় রচনা যথা- লোককাহিনী, লোকসংগীত, গাঁথা, ছড়া মন্ত্র ধাঁধাঁ ইত্যাদি গদ্যে ও পদ্যে বানীবদ্ধ আকারে লোকসমাজে প্রচলিত আছে। শ্রুতি ও স্মৃতি বাহিত এসব রচনা মুখে মুখে প্রচারিত হয় বলে এসব রচনাকে মৌখিক সাহিত্যে বলা হয়। আর বানীবদ্ধ হওয়ায় এগুলোকে বাগাশ্রিত লোককলা বলা হয়।অন্যদিকে, চারু ও কারু লোকশিল্পে যাবতীয় নিদর্শন হলো (খ) বস্তুগত লোককলা।


লোককলার বিষয়বস্তু ও পরিধি ব্যাপক তেমনি লোককলার বৈশিষ্ট্য। লোককলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেকেই বলেছেন। ডান বেন আমোস এ সম্পর্কে বলেন Folklore is artistic communication in small groups. অর্থাৎ লোককলা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার শৈল্পিক মাধ্যম। তার মতে লোককলা সংস্কৃতির দর্পন, কিন্তু তা গতিশীল উপাদান নয়। এতে ব্যক্তিত্বের ছাপ থাকলেও ব্যক্তিত্বের ক্রিয়াশীলতা নেই। তবে তার এরূপ মন্তব্যের বিপরীত মন্তব্য ও থাকতে পারে। লোকলায় সৃজনশীলতা ও গতিশীলতার মাত্রা কম হতে পারে, তবে অভাব আছে তা বলা যায় না।


এ্যালান ডান্ডিস (১৯৬৪-২০০৫) লোককলার কে নানা অভিধায় আখ্যাত ও বিভিন্নভাবে তার বৈশিষ্ট্য সংজ্ঞায়িত করেছেন। লোককলার ভাবার্থসহ বৈশিষ্ট্য গুলো তুলে ধরা হলো • লোককলা হলো মানব সংস্কৃতির দর্শন, সমাজের লেন্স, আচরনের চাবি ও মনের প্রতিবিম্ব।লোককলা সমাজের মূল দলিল।


• লোককলা হলো- জনসাধারণের 'প্রতিকী আত্মজীবনী' লোককলা সমাজের অন্তর, বাইরের দৃশ্যপট তুলে ধরে।

• সাধারণ মানুষ যা চিন্তা করে, লোককলা তার বার্তাবহন করে, প্রতিদিনের কথাবার্তায় যা বলা সম্ভব হয় না, তারা তাদের গল্পে-গানে প্রকাশ করে।

• মানবতা যত প্রাচীন লোককলা ততই প্রাচীন।লোককলা জ্ঞান ও মূল্যবোধ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটি সমৃদ্ধ ও অর্থপূর্ণ উৎস।

• লোককলা স্থানিক হয়েও বৈশ্বিক, পুরাতন হয়েও নতুন।লোককলা সমাজ ভেদে ভিন্ন হযে থাকে, এক সমাজের এক এক নিয়মকানুনে


লোককলার ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। বর্তমানে লোকসমাজ সম্পর্কে চেতনা পরিবর্তন হয়েছে। বলা হচ্ছে, কেবল গ্রামের মানুষ 'Folk' নয়, শহরের মানুষ ও 'Folk' হতে পারে। শহরবাসীও নানা কুসংস্কার বিশ্বাস করে এবং তদনুযায়ী আচারদি পালন করে থাকে। অর্থাৎ গ্রাম হোক, শহর হোক যারা লৌকিক ধ্যান ধারণা পোষন, কুসংস্কার লালন এবং আচারদি পালন করে, তারাই Folk নামে অভিহিত হবে। পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে আমেরিকার লোককলাবিদগন মনে করেন, আধুনিক শহর ও শিল্পনগরে শ্রমজীবী-পেশাজীবী মানুষের নতুন ভাবে লোককলার উপাদান বিকশিত হয়- শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তবে শহরের বর্হির্জীবনে পরিবর্তন সাধিত হলেও অন্তর্জীবনে পরিবর্তন অল্পই ঘটে।


লোককলার বিপুল সম্পদের সাথে বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠীর নাড়ির নিবিড় সম্পর্ক আছে। নৃতত্ব, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্যের নানা বীজ এসবের মধ্যে প্রোথিত আছে। প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় লোককলার প্রভাব অসীম। মূলত লোককলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে একটি দেশের সমাজ, সংস্কৃতি সাহিত্য, সভ্যতার ইতিহাস লোককলা বাংলা সাহিত্যকে পূর্ণতা দান করে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন- মঙ্গলকাব্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পুঁথিসাহিত্য ইত্যাদি। সমাজ, সংস্কৃতি ও


সভ্যতা গড়তে লোককলার ভূমিকা মুখ্য। ভাই বর্তমানের কোনো নতুন কাজ ও অতীতের চিন্তা-চেতনা অর্থাৎ লোককলা দ্বারা প্রবাহিত হয়ে থাকে। তাই জাতিসত্তার পরিচয় নির্ণয় করার জন্য লোককলার পঠন-পাঠন আবশ্যক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ