লোকসাহিত্য বা লোককলার সংগ্রহ পদ্ধতির বিবরণ দাও।

লোককলার সংগ্রহ পদ্ধতি

সংজ্ঞা

"একটি সংহত সমাজের মানুষ পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে মুখে মুখে বা হাতে-কলমে লব্ধজ্ঞানের এবং অভিজ্ঞতার আলোকে ঐতিহ্য নির্ভর যা কিছু সৃষ্টি করে, তাকেই লোককলা বলে। "লোককলা অতীতের বিষয় হলেও তা জীবন্ত। কারণ, তা রুপান্তর বিবর্তনের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে স্থান-কাল- পাত্রের সাথে থাপ খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।



লোককলার সংগ্রহ পদ্ধতি:-

লোককলাকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য এর উপদান সংগ্রহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংগ্রহের কাজ যত নির্ভুল ও বিজ্ঞানসম্মত হবে, লোককলার গবেষণা ও নিখুঁত ও অর্থপূর্ণ হবে। কিন্তু বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক এই উপাত্ত সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁরা সর্বাংশে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ করেন নি। তাঁরা ব্যাক্তির অভিপ্রায়কে অধিক মূল্য দিয়েছেন। উপরন্তু অন্যের সংগ্রহের ওপর বেশি নির্ভর করেছেন। ফল হয়েছে এই যে, তাঁদের গবেষণায় গভীরতা, মৌলিকতা ও নির্ভরযোগ্যতা বাড়ে নি।


দীনেশচন্দ্র সেন,চন্দ্র কুমার দে, আশুতোষ চৌধুরী, জসীমউদ্দিন সহ অনেককে দিয়ে গীতিকা, গান, গাঁথা, ধাঁধা ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। তাঁদের সংগ্রহের উপর তিনি নিজস্ব কলম চালিয়েছেন। তিনি চাষাভুষার জিনিসকে ভদ্র করার চেষ্টা করেছেন। ফলে 'মৈমনসিংহ-গীতিকা' ও 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' কতখানি খাঁটি আর কতখানি হস্তক্ষেপজনিত কৃত্রিম, তা নির্ণয় করা যায়না। সঠিক পদ্ধতি অনুসৃত হলে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক কে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা পুনরায় প্রকাশ করতে হতো না। এগুলো আমাদের সংগ্রহ পদ্ধতির ত্রুটিকেই নির্দেশ করে।


এখন সবকিছু গোড়া থেকে শুরু করা উচিত। অতীতের সংগ্রহসমূহকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন আছে archetype, oikotype পাঠ বিশ্লেষণ এবং synchronic , diachronic পদ্ধতির আলোচনার জন্য। লোককলার সংগ্রহ- পদ্ধতি নির্ভুল হলে গবেষণার ফলাফল মৌলিক ও সত্যসন্ধী হয়। লোককলার উপাদানসমূহ উপযুক্তভাবে সংগৃহীত হলে সেগুলোর গুণগত ও পরিমাণগত ব্যাপ্তি ও গভীরভা সমন্ধে জানা যায়। বলা হয়, সঠিক পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হলে অর্ধেক গবেষণার কাজ হয়ে যায়। এজন্য বর্তমানে বিজ্ঞানভিত্তিক সংগ্রহের আর যুক্তিনিষ্ঠ গবেষণার তুল্য-মূল্য গুরুত্ব প্রদান করা হয়।


এখন প্রশ্ন হলো- বিজ্ঞাননির্ভর এই তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতিটি কী? লোককলার উপাত্ত সংগ্রহের সাথে ক্ষেত্র সমীক্ষা (field work) ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সংগ্রহের পুরো বিষয়কে এককথায় ক্ষেত্র সমীক্ষা' বলা হয়। লৌকিক উপাদানসমূহ তাদের জীবন্ত পরিবেশ কিভাবে আছে, সরেজমিনে থেকে সেসব সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মূল্যায়ন করাই হলো ক্ষেত্র সমীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য।


শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্র-সমীক্ষার চারটি স্তরের কথা বিবেচনা করা হয়েছে:


১.পরিকল্পনা (Planning)

২.পূর্ব প্রস্তুতি (Preparation)

৩. ফেত্রানুসন্ধান (Field work)

৪.সমীক্ষনোত্তর অনুশীলন (post analysis )


লোককলার পরিধি বিশাল, প্রকৃতি বিচিত্র। সবকিছু নিয়ে একজনের পক্ষে গবেষণা করা সম্ভব নয়। এজন্য আগে তাঁকে একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচন এবং সে বিষয়ের একটি সম্ভাব্য রূপরেখা ( outline) প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচিত বিষয় সম্পর্কে তিনি উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। অতএব তাঁর বিষয়জ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট তত্ত্ব-জ্ঞান সম্পর্কে ধারনা থাকা আবশ্যক। বিষয়-পরিকল্পনার সাথে সাথে কোন স্থানের উপাত্ত সংগ্রহ করবেন সেটাও নির্ধারণ করা জরুরি। সংগ্রহ স্থলে যাত্রার পূর্ব প্রস্তুতির পর্ব আছে। এ স্তরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে সংগ্রহকের নানা দায়িত্ব থাকে। যেমন:


• যে বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হবে, সে বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত গ্রন্থাদি পাঠ করা জরুরি;

• যে স্থানে ক্ষেত্রানুসন্ধান করা হবে, সে জায়গার ভূগোল, ইতিহাস, আঞলিক ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে।

• স্থানীয় মানচিত্র সংগ্রহ করতে হবে।

• প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, পেন্সিল, ইত্যাদি বহন করতে হবে।

ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার, ভিডিও, টর্চ ব্যাটারি ইত্যাদি বহন করতে হবে।

• প্রশ্নোত্তরলিপি ও তালিকাসূচি প্রস্তুত করতেহবে এবং কাজের সম্ভাব্য সময়-সীমা নির্ধারণ করতে হবে।


বিঃদ্রঃ-লোককলা সংগ্রাহকের দুটি গুণ থাকা অতি আবশ্যক। তা হলো- তথ্যনিষ্ঠা ও সততা। তৃতীয় স্তরে নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হয়ে স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, এবং দুরত্ব বজায় না রেখে লোকালয়ে অবস্থান করাই উত্তম। এরপর প্রথম ও প্রধান কাজ হবে- প্রকৃত তথ্যদাতার অনুসন্ধান করা। তথ্যদাতার মধ্যে কে 'সক্রিয় ঐতিহ্য-বাহক' আর কে 'নিষ্ক্রিয় ঐতিহ্য-বাহক' তা লক্ষ্য রাখতে হবে।


উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- কেউ যদি লোকসংগীত সংগ্রহ করতে চান তবে সে ক্ষেত্রে গায়েন বা বয়াতি হবে সক্রিয় ঐতিহ্য বাহক আর গ্রামবাসীরা হবে নিষ্ক্রিয় ঐতিহ্য বাহক। মনে রাখতে হবে যে, সংগ্রাহক ও তথ্যদাতার মধ্যে যতদূর সম্ভব দূরত্ব কমিয়ে আনা। এজন্য তাঁদের মধ্যে কুশল বিনিময় করা, কিছু উপহার দেওয়া ইত্যাদি প্রয়োজন হতে পারে। তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার গ্রহন, প্রশ্নোত্তরলিপি পূরণ, তালিকা প্রস্তুত ইত্যাদি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হবে।


এসব প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত উপাত্তের অর্থ, উপলক্ষ, কাল-পাত্র বিশেষ শব্দের অর্থ, টীকা ইত্যাদি বিষয়ে নোট করতে হবে। অর্থাৎ উপাত্তটি সে কিভাবে পেয়েছে, তার বয়স, পেশা শিক্ষা, ঠিকানা কি ইত্যাদি রেকর্ড করতে হবে। লোককাহিনী, ধাঁধা, প্রবাদ সংগ্রহের সময় বক্তা কিভাবে ও কিরূপ ভাব-ভঙ্গির মাধ্যমে তা পরিবেশন করে, সেসব ভিডিও তে রেকর্ড করা জরুরি। উল্লেখ্য, লোকসংগীত টেপরেকর্ডে ধারণ করাই উত্তম। লোকশিল্পের নমুনা গুলো ক্যামেরা বদ্ধ ও তথ্যদাতার প্রদত্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। তথ্যদাতার প্রাপ্ত বিবরণ, ব্যাথা, মন্তব্য সর্বত্রই বানীবদ্ধ করতে হবে। এছাড়া সংগ্রাহক স্বীয় পর্যবেক্ষণজনিত অভিজ্ঞতার কথাও লিপিবদ্ধ করতে হবে।


এভাবে সংগৃহীত তথ্যের সাহায্যে পরবর্তীকালে স্লাইড, স্কেচ, গ্রাফ, স্বরলিপি ইত্যাদি তৈরী করতে সহায়ক হয়। পরিবেশনা-শিল্পের জন্য ভিডিও এবং আলোকচিত্র খুবই উপকারে লাগে। সংগ্রহ গবেষণা নিজেই করতে হবে এবং অন্য সংগ্রাহকে সাহায্য করতে হবে। পদ্ধতিটি নিখুঁত হওয়া অতীব আবশ্যক। আবার রেকর্ডের ক্ষেত্রে চিত্রভিত্তিক বর্ণনার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাই প্রত্যাশিত।


মাঠে সংগ্রাহক ও তথ্যদাতার মধ্যে সম্পর্ক হবে অন্তরস; প্রীতিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য। শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই হোক না কেন। ব্যাবধান যত লঘু হবে পদ্ধতির জন্য ততই মঙ্গল হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, উচ্চমন্যতার ভাব একেবারেই পরিহার করা উচিত। তবে তথ্যদাতা অনেক হলেও বাধা নেই বা সমস্যা নেই; বরং বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য উদ্ঘাটনে অধিক সহায়তা করে।


বর্তমানে তথ্যদাতা ও সংগ্রাহককে সমতূল্য মর্যাদা দেওয়া হয়। এজন্য তথ্যদাতার স্থলে 'পরস্পর তথ্য- সন্ধানী' হিসেবে গন্য করা হয়। আবার কোথাও তাঁকে 'ক্ষেত্র-বন্ধু ' রূপেও পরিগনিত করা হয়।ক্ষেত্র-সমীক্ষণের পরে চতুর্থ স্তরে আছে সংগৃহীত তথ্যসমূহের শ্রেণীকরণ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ, গবেষণা ইত্যাদি। 


এক্ষেত্রে তথ্যদাতার ভাষ্য, ক্যামেরা-ধারণকৃত চিত্র আলোকচিত্র, ব্যাথা- বিশ্লেষণ এসব কিছুর সমন্বয়ে অনেক বিষয়ে গবেষনা ও শিক্ষণ পূর্ণতা লাভ করে। বর্তমানে লোককলা চর্চায় ক্ষেত্র-সমীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কারণ মূলবিষয় ও প্রসঙ্গ সম্পর্কে ধারণা পেতে এটাই সংগত পদ্ধতি। তবে লোককলার গবেষণা কেবল মূল ও প্রসঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখন তা intertextuality-র দিকে প্রসারিত হয়েছে। শব্দ, শব্দার্থ, অলংকার, ছন্দ, প্রতীক, রূপক ইত্যাদি প্রসঙ্গ আলোচিত হয় এই মূলের অবয়ব বৈশিষ্ট্যে। আলোচনা বিষয়গত হোক বা রূপভাষিক হোক, texture-এর গুরুত্ব সব সময় থেকে যায়।


মূল পাঠকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট এসব বিষয় আলেচনার প্রধান লক্ষ্য হলো, উপাত্তটি কোন পরিবেশে, পরিস্থিতিতে জন্মলাভ করেছে; এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় উপযোগিতা কী, লোকমাধ্যম হিসাবে সমাজের ভেতরে কিরূপ ভুমিকা পালন করে চলছে, স্মৃতিতে টিকে থাকার শক্তি কোথায় ইত্যাদি বিষয়ের সন্ধান পাওয়া।

তাই বলা যায় যে, ক্ষেত্র-সমীক্ষার প্রাপ্ত তথ্যসমূহ লোককলা গবেষণার দ্বার উন্মোচিত ও ক্ষেত্র প্রসারিত করে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ