‘আবদুল্লাহ্” উপন্যাসে মুসলিম নারী জীবনবাস্তবতা
কাজী ইমদাদুল হক রচিত একমাত্র উপন্যাস 'আবদুল্লাহ্”। ১৯৩৩ সালে রচিত। এ উপন্যাস বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের সময়সীমায় প্রবাহিত মুসলিম জীবনবিশ্বাস এবং জীবন-যন্ত্রণার শিল্পিতভাষ্য। আবদুল্লাহ্ এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। যিনি কুসংস্কার আর পীর-প্রথার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। যাঁর জীবনদৃষ্টি ছিল অসাম্প্রদায়িক নতুন এক সমাজের। চরিত্রের এই মৌল আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিকের অন্তর্দৃষ্টি, প্রত্যয় ও প্রত্যাশার গভীর যোগসূত্র মেলে।
আবদুল্লাহ উপন্যাসের বিষয়বস্তু।।
তিনি যেমন তৎকালীন সমাজের পীরপ্রথা, আশরাফ-আতরাফ বৈষম্য, পর্দাপ্রথা ইত্যাদি নানা সমস্যাকে মুসলমানদের অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে দেখেছেন তেমনি অবরোধের কঠোর শৃঙ্খলে রেখে নারীদের কীভাবে দমিয়ে রাখা হয় সেই চিত্রও এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।এ উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো পুরুষ চরিত্রের তুলনায় একান্তই নিষ্প্রভ। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, যে সময়ের চিত্র এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে সে সময়ে নারীরা ছিল ধর্মীয় সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ।
![]() |
পর্দা প্রথার বাড়াবাড়িতে মুসলিম নারীর জীবন ছিল দুর্বিসহ। অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলমান সমাজে নারী ছিল অবহেলিত। নারী স্বাধীনতার লেশমাত্র ছিল না সে সমাজে।এ কারণেই উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো বিকশিত হতে পারেনি। প্রচলিত অর্থে এখানে কোন নায়িকা চরিত্র নেই।নারী চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আবদুল্লাহর মা, আবদুল্লাহর বোন হালিমা, স্ত্রী সালেহা, মালেকা এবং রাবিয়া এরা প্রত্যেকেই বিশ শতকের প্রথম পাদের মুসলিম নারী সমাজের প্রতিনিধি। আর এ কারণেই উপন্যাসে এদের আত্মত্মবিকাশ সম্ভব হয়নি। বাস্তবের প্রতি কাজী ইমদাদুল হকের বিশ্বস্ততাই এর মূল কারণ।
লেখক তার উপন্যাসে যে সময়কার সমাজচিত্র অঙ্কন করেছেন সেই সময় সমাজ প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক জীবনাশ্রয়ী এবং ধর্ম ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো। এই ধর্ম ও সংস্কারাশ্রিত সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নারী স্বাধীনতার অস্বীকৃতি। সমাজ ও সংসারে নারীর যে কোন ভূমিকা থাকতে পারে তা এই সমাজ স্বীকার করেনি। তারপরেও আবদুল্লাহর মাতা, হালিমা ও রাবেয়ার অন্তরের যে মাধুর্যটুকুর সঙ্গে আমরা পরিচিত হই তা মনোরম |
সালেহা তার পিতার খুব অনুগত ছিল এবং শৈশব থেকে তাঁকে অনুকরণ করে আসছে। পিতার মতো সেও মনে করত, ‘ইংরেজি পড়লে খোদার উপর আর লোকের তেমন বিশ্বাস থাকে না।” পিতার রক্ষণশীল খানদানি আভিজাত্যের বলয়ে সালেহা পীরের মুরিদ হয়ে নিজেকে নামাজ ও ওজিফাতে দ্বিগুণ উৎসাহে নিয়োজিত রেখেছে। সালেহা আবদুল্লাহর স্ত্রী, তাই উপন্যাসের নায়িকা। কিন্তু নায়িকা হয়েও পার্শ্বচরিত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
পার্শ্ব চরিত্রেরও কখনো কখনো জোরদার ভূমিকা থাকে। যা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে কোন ক্ষেত্রেই হতে পারে। কিন্তু এখানে সালেহার উপস্থিতি কিংবা ভূমিকা নেই বলাটাই অনেকাংশে সত্য। যার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক সমাজ সংসারে একদা নারীর অবস্থান কিরূপ ছিল সেটাই মূলত চিত্রিত করেছেন।
সালেহাকে চিত্ররূপ দিতে গিয়ে মুসলিম সমাজে সেই সময়ের নারীর অবস্থান কেমন, সেটাই প্রাধান্য পেয়েছে। পরনের কাপড় ও দরজায় ইসলামি আদর্শের প্রতীকরূপে সবুজ বর্ণের রং। সমাজে নারী নিশ্ছিদ্র অবরুদ্ধে, তাই খোপকাটা জালের মতো শাড়ি। দরজার বন্ধ খড়খড়ির ভেতর দিয়ে বলতে চেয়েছে, ধর্মীয় চেতনা ও পিতার আভিজাত্যবোধের যূপকাষ্ঠে সে অন্তরীণ। স্বামী আছে কিন্তু স্বামীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত দরজার একটা পার্ট খুলে প্রাণহীন সালেহা সজল করুণ দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে, ঘরের জানালার ওপরে ঝিনুকের মাঝের খোলায় কোরআনের আল্লাহ লেখা একটি ছবি।
জানালায় লম্বালম্বি শিক, সেখানে সূর্যের রক্তিমাভা নিয়ে বাতাসে হালকাভাবে কেঁপে ওঠে পর্দা। সেই পর্দাও যেন লোহার শিকে আবদ্ধ। মেঝেতে জায়নামাজ বিছানো, ধর্মীয় আচার-নিষ্ঠায় সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত থাকার জন্য। আবদুল্লাহ শিক্ষিত ও উদার। সে সংস্কারমুক্ত হয়ে বাঁচতে চায়। তাই তার স্ত্রী সালেহা যখন তাকে পায়ে ধরে সালাম করার জন্য নত হয়, তখন তাকে বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ করে। সালেহা স্বামীর এরূপ আচরণকে মনে করে বেহায়াপনা, অন্যায়। সালেহা বলে,
"আপনি বড় অন্যায় করেন।আবদুল্লাহ চৌকির ওপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী অন্যায় করি?"... সালেহা কহিল, 'এই-এই-সালাম করতে দেন না আর কি! এতে যে আমার গোনাহ হয়। "
নারীর অধিকারের ক্ষেত্রেও অভিশোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছিল। সে সময় নারীদের কোন স্বাধীনতা ছিলনা। সৈয়দ পরিবারের পুত্রবধূ হালিমা স্বামীর কি শ্বশুরের বিনা হুকুমে মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকেও দেখতে যেতে পারেনি। সমাজে নারীদের চলাচলের কোন স্বাধীনতা ছিল না। সে সময় অবরোধ প্রথা ছিল অত্যন্ত কঠোর। পর্দা প্রথার বাড়াবাড়িতে নিষ্পেয়িত ছিল নারীদের জীবন। প্রবাসী স্বামীর কাছে চিঠিপত্র লেখা হারাম বলে বিবেচিত হতো।
গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়ও স্ত্রীলোকদের ডাক্তার দেখানো হতো না ।তৎকালীন সমাজে স্ত্রী শিক্ষা প্রসার লাভ করতে পারেনি। সে সময়ে নারীরা ছিল আধুনিক শিক্ষা ও জীবনবোধের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। সৈয়দ পরিবারে স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে যে ধারণা ছিল, তা হলো- “পড়াশুনার মধ্যে কোরআন শরীফ, তাহার উপর বড়জোর উর্দু মেফতাহুল জেন্নত পর্যন্ত; ইহার অধিক বিদ্যা তাঁহাদিগের পক্ষে নিষিদ্ধ ফল।
লেখা- তা সে উর্দুই হাক আর বাঙলাই হোক, আর বাঙলা পড়া, এসকল তো একেবারেই হারাম।” এখানে তৎকালীন মুসলিম সমাজে স্ত্রী শিক্ষার বাস্তব চিত্রটি লেখক সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।এছাড়াও আবদুল্লাহর মুখ দিয়ে ইমদাদুল হক স্ত্রী শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করতেন। স্ত্রী শিক্ষা ব্যতিরেকে কোন জাতিই উন্নতি লাভ করতে পারে না বলে তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন। --
"বিশেষতঃ যতদিন স্ত্রী শিক্ষা সমাজে প্রচলিত করা না যাইতেছে, ততদিন মুসলমানদের কুসংস্কারের আবর্জনা দূর হইবে না, এবং তাহা না হইলে সমাজের উন্নতি একেবারেই অসম্ভব।”
আবদুল্লাহর মধ্য দিয়ে এখানে লেখকের নিজের বক্তব্যই প্রকাশ পেয়েছে। আবদুল কুদ্দুসের মতো রক্ষণশীল বাড়ির মেয়েদের বাংলা পড়তে লিখতে জানাও অপরাধ বলে গণ্য হত। আবদুল কাদেরের স্ত্রী হালেমা, আবদুল্লাহর বোন । সে বিয়ের আগেই পড়াশোনা শিখেছিল। বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে তার চর্চাও রেখেছিল। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির অত্যধিক শাসন আর উৎপাতে তাকে সে অভ্যাস নষ্ট করতে হয়েছে। স্বামীর চিঠির উত্তর লেখাও পছন্দ করত না।
“জানানাদের পক্ষে লেখাটেখা হারাম” এই নির্দেশে এবং স্বামীর কাছে লেখা চিঠি ভাসুরের খুলে পড়ার কারণে হালিমা লেখালেখির পাঠ চুকিয়ে দিতে বাধ্য হয়। আধুনিক শিক্ষাকে মেনে নিতে না পারার খেসারত কীভাবে মুসলিম সমাজ বহন করেছে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত এই ‘আবদুল্লাহ' উপন্যাস।
মুসলমান সমাজে পর্দা প্রথার দোহাই দিয়ে নারীর প্রতি অমানবিক আচরণেরও বিরুদ্ধাচরণ করেছেন লেখক। এ উপন্যাসে দেখা যায় গুরুতর অসুস্থ হালিমাকে ডাক্তারী চিকিৎসার জন্য সদরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে সৈয়দ সাহেব আপত্তি করেন। তাঁর মতে, “মান সম্ভ্রম তোমরা আর কিছু রাখলেনা দেখছি!" আবদুল্লাহ বেশ একটুখানি প্রতিবাদের সুরে বললো, "মান সম্ভ্রমের কথা পরে, জান বাঁচান আগে।” আবদুল্লাহর এ প্রতিবাদ প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
সেই নিশ্ছিদ্র পর্দাপ্রথার জন্য 'আবদুল্লাহ্' উপন্যাসের রোগিণীর বক্ষে ডাক্তার স্টেথেস্কোপ স্পর্শের অধিকার পায়নি। শেষ পর্যন্ত রোগিণী মারাও গেছে। অথচ উপন্যাসের নারীচরিত্রগুলির মধ্যে তার জন্য কোনো ক্ষোভ প্রকাশ পায়নি। এই অপরাধের বিরুদ্ধে রোকেয়ার মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর বক্তব্য "মেছোনীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে পচা মাছের দুর্গন্ধ ভালো না মন্দ?" সে কি উত্তর দিবে?” মেছোনীর মতো অবরোধবাসিনীরাও জন্ম থেকেই অন্ধকারে থেকে থেকে আলোকিত জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।
আর ‘পেচকে'র মতো গৃহকোণে লুকিয়ে থেকে শরীফের মর্যাদার আত্মসন্তুষ্টি লাভ করে। তাদের লুকিয়ে রাখার জন্য ধর্মের ধ্বজাধারীরা ফতোয়া জারি করেই ক্ষান্ত নন, তার প্রয়োগেও সিদ্ধহস্ত। এই বাস্তব চিত্রের নমুনা ‘আবদুল্লাহ্” উপন্যাসে লেখক সুনিপুণভাবে পরিস্ফুট করেছেন। আর প্রতিবাদ জানিয়েছেন নায়ক আবদুল্লাহর মুখ দিয়ে। আবদুল্লাহর বিদ্রোহী মনে নারী-ভাবনা একটা বিরাট অংশ জুড়ে বসেছে। কেবল বেপর্দা হওয়ার ভয়েই স্ত্রীকে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি সে শ্বশুরের কাছ থেকে আদায় করতে পারে নি।
সেই আসন্নপ্রসবা স্ত্রীকে আবদুল্লাহ দেখতে পেয়েছে ছ-মাস বাদে যখন সে মৃত। তাই ঔপন্যাসিক আখ্যানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মৌলবাদীদের সঙ্গে সংঘাত বাধিয়েছেন আবদুল্লাহর। যেখানে নারীদের চেতনা বা প্রতিবাদের ভাষা অনুজ্জ্বল সেখানে নায়কের সোচ্চার বিরোধিতা নজর কাড়ে—“অত শরীয়তের ধার ধারিনে ভাই সাহেব; এইটুকু বুঝি যে মানুষের সুখ সুবিধারই জন্য শরা-শরীয়ত জারি হয়েছে: বে-ফায়দা কালে-অকালে কড়াকড়ি করে মানুষকে দুঃখ দেবার জন্য হয়নি।”
মুসলিম সমাজে নারীর কোন স্বাধীনতা ছিল না। কঠোর পর্দা প্রথার অন্তরালে বন্দী ছিল নারীদের জীবন। ট্রেনে যাতায়াত করলে মেয়েদের আব্রু থাকবে না বলে পুরুষরা ট্রেনের পরিবর্তে মেয়েদের নৌকায় যাতায়াতকেই বেশী পছন্দ করতো।
আবদুল্লাহ্ তার স্ত্রী সালেহাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা বললে সৈয়দ সাহের বললেন- “আমাদের খান্দানে কোনও জানানা কখনও এ পর্যন্ত রেলে চড়েনি, আর আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন চড়তে দেবারও আমার ইচ্ছা নাই। এই চিত্রের মধ্য দিয়ে আমরা তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারীদের জীবনবাস্তবতা দেখতে পাই ।
উপন্যাসে বর্ণিত নারী চরিত্রগুলো পুরুষ চরিত্রের তুলনায় অনেকটা গৌণ। ব্যক্তিত্ব এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকার অভাবে উপন্যাসে নারীচরিত্রগুলো ভালোভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারে নি। তারপরেও এই নারীচরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক বিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম সমাজে নারীদের জীবনবাস্তবতা তুলে ধরেছেন। আলোচ্য উপন্যাসের নারী চরিত্র প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক, গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষের মন্তব্য হলো:
“আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে নারী আছে, কিন্তু কোন নারী চরিত্র নেই যারা ব্যক্তিত্বে-প্রেমে-সংগ্রামে-সত্তায় সমুজ্জ্বল। কারণ একটাই, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম সমাজে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের চরম অবরোধ । ”
আব্দুল্লাহ উপন্যাসের সমাজ চিত্র।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের সমাজ বাস্তবতা।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের রাবেয়া চরিত্র।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের রচয়িতা কে।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের উপজীব্য।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের কাহিনী।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের লেখক কে।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের বিষয়বস্তু।আব্দুল্লাহ উপন্যাসের চরিত্র।আব্দুল্লাহ উপন্যাস।আবদুল্লাহ উপন্যাসের সামাজিক গুরুত্ব।আবদুল্লাহ উপন্যাসের সমালোচনা।
0 মন্তব্যসমূহ