নীতিবিদ্যা ও কান্টের নৈতিক মতবাদ।
নীতিবিদ্যা: 'মূল্যবিদ্যা'র (Axiology) শাখা তিনটি৷ যথা-
১.যুক্তিবিদ্যা,
২. নীতিবিদ্যা,
৩. নন্দন তত্ত্ব৷
নীতিবিদ্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Ethics' যার উৎপত্তি গ্রিক শব্দ 'ethica' থেকে৷
জে. এস. ম্যাকেনযি (Mackenzie) বলেন,
নীতিবিদ্যাকে এই বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় যে, ''আমাদের আচরণে ন্যায্য কী অথবা ভাল কী, নীতিবিদ্যা হচ্ছে সেই বিষয়ের অনুসন্ধান।''
একে 'moral philosophy' বা 'নীতি দর্শন'ও বলা হয়। অর্থাৎ নীতিবিদ্যা হচ্ছে, নৈতিকতা, নৈতিক সমস্যা ও নৈতিক নির্ধারণ সম্পর্কে দার্শনিক চিন্তন। এভাবেও বলা যায়, দর্শনের যে শাখা values, good values, মানুষের আচরণের (conduct) ভালোত্ব, মন্দত্ব, ঔচিত্য, অনৌচিত্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে সে শাখাকে নীতিবিদ্যা বলে।
আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, নীতিবিদ্যা হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর আচার-আচরণের (conduct) ভালত্ব ও মন্দত্ব বা ন্যায্যতা ও অন্যায্যতা সম্পর্কিত আলোচনা। এতে আমরা জানতে চাই 'ভাল’ ও ‘ন্যায্য' কথা দুটির অর্থ এবং ব্যাখ্যা করতে চাই কর্তব্য, দায়িত্ব, সদগুণ ইত্যাদি ধারণাগুলো। কিন্তু মানুষের সকল ধরনের আচরণ নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় নয় বরং সে গুলো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার বা 'psychological matter'।
নীতিবিদ্যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নৈতিক কাজের পরম মানদণ্ডের সংজ্ঞা দেওয়া এবং কোন কাজ ন্যায়সম্মত আর কোন আচরণ বা চরিত্র সদগুণসম্পন্ন তা নির্ণয়ের নীতিমালা নির্ধারণ করা। আর পরণতি দেখেই কিন্তু নৈতিকতার মানদণ্ড ঠিক করা হয়।
নীতিবাদের ধরন:নীতিবাদের ৪ টি ধরন রয়েছে, যথা-
১. পরণতিমূলক মতবাদ,
২. ধর্মভিত্তিক নৈতিক মতবাদ,
৩. কর্তব্যভিত্তিক মতবাদ এবং
৪. কর্তাভিত্তিক মতবাদ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান দার্শনিক কান্টের নৈতিক মতবাদ-বিচারবাদ বা কৃচ্ছ্রতাবাদ (Kant's theory of Ethics- Rationalism or asceticism) সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো, এবং তা নিম্নরূপ: জার্মান দার্শনিক কান্টের নৈতিক মতবাদ 'উগ্র-বিচারবাদ' বা 'কৃচ্ছ্রতাবাদ' নামে পরিচিত। কান্টের নৈতিক মতবাদ নীতিবিদ্যার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ও অতি মূল্যবান মতবাদ হলেও তার গভীরে প্রবেশ করে সঠিক তাৎপর্য নির্ণয় করা সহজসাধ্য নয়।
এজন্য, কান্টের নীতিতত্ত্বের তিনটি মূল ও পরস্পর-সম্পৃক্ত বিবৃত্তির কথা উল্লেখ করার পূর্বে তাঁর নৈতিক মতবাদকে সহজবোধ্য করার প্রচেষ্টা করা হল, নৈতিকতার আচরণ ৩ টি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যথা-
১. ব্যক্তি বা ব্যক্তিক (individual) নিয়ম,
২. সার্বজনীন নিয়ম অর্থাৎ নিজের জন্য ভালো আর অন্যের জন্য খারাপ এমন না এবং
৩. নৈতিকতাবাদে মানুষের মর্যাদা রক্ষিত হয় এবং মানুষ উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে না।
প্রকৃতপক্ষে, কান্টের নৈতিক মতবাদ তিনটি বিবৃতির ওপর নির্ভরশীল। যথা-
১. সদিচ্ছাই একমাত্র সৎ,
২. কর্তব্যই কর্তব্যসাধনের লক্ষ্য এবং
৩. নৈতিক নিয়ম এক নিঃশর্ত আদেশ।
১. সদিচ্ছাই একমাত্র সৎ:
১. কান্টের নীতিতত্ত্বের প্রথম সূত্রটি একটি আপাত-বিরোধী উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
২. এই জগতে, এমনকি জগতের বাইরেও, সদিচ্ছা ব্যতীত নিঃশর্ত ভাল আর কিছুই নেই।
৩. সদিচ্ছাই কেবল নিঃশর্তভাবে সৎ, আর সবই শর্তযুক্তভাবে সৎ।
অর্থাৎ এই বিষয়টিকে কান্ট দুইভাবে বুঝিয়েছেন: প্রথমত, সদিচ্ছা ভিন্ন আর সব ভাল শর্তাধীনভাবে ভাল; সম্পদ, স্বাস্থ্য, জ্ঞান-বুদ্ধি, —এসব নিঃসন্দেহে ভাল যদি এবং কেবল যদি ঐসবের সঙ্গে সদিচ্ছা যুক্ত থাকে, কিন্তু সদিচ্ছার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে সম্পদ, স্বাস্থ্য, জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রভৃতি যদি অসদিচ্ছার দ্বারা চালিত হয়, তাহলে তারা প্রত্যেকে অত্যন্ত মন্দ হতে পারে, জগতের কল্যাণের পরিবর্তে বরং অকল্যাণের কারণ হতে পারে।
আমরা সাধারণত সম্পদ, স্বাস্থ্য, জ্ঞান-বুদ্ধি প্রভৃতিকে 'ভাল' বলে গ্রহণ করলেও, কান্টের মতে, তাদের ভালত্ব সদিচ্ছার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কান্টের এই অভিমত যে কতটা সত্য তা বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কলঙ্কিত ইতিহাসই প্রমাণ করে— শুভবুদ্ধির অভাবে মানুষ তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফসল মরণাস্ত্র অ্যাটম বা আনবিক বোমার আঘাতে জাপানের দুটি জনবসতি নগরকে মনুষ্যবর্জিত শশ্মানে পরিণত করে।
দ্বিতীয়ত, সদিচ্ছা স্বতোমূল্যবান অর্থাৎ নিজে নিজেই ভাল। সদিচ্ছার সঙ্গে যদি অন্য কিছু যুক্ত নাও থাকে, সদিচ্ছার সঙ্গে যদি প্রত্যাশিত ফলের যোগসাধন নাও হয়, তথাপি ঐ সদিচ্ছা 'সদিচ্ছারূপে'ই থাকে। কান্ট বলেন, 'যদি শত চেষ্টাতেও সদিচ্ছা তার আশানুরুপ ফললাভ থেকে বঞ্চিত হয়, তথাপি ঐ সদিচ্ছা উজ্জ্বল রত্নের মত স্বতোমূল্যবান বস্তুরূপে নিজপ্রভায় আলোকিত থাকবে।'
স্পষ্টতই, কান্ট ফলমুখী নৈতিকতাকে পুরোপুরি পরিহার করে কর্তব্যমুখী নৈতিকতাকে সমর্থন করেছেন। স্বেচ্ছাকৃত কর্মের ভালত্ব/মন্দত্ব কর্মফলের ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে কর্তার সদিচ্ছার ওপর। কান্ট কর্মফলকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল কর্মনীতিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ নৈতিকতা কাজের ধরনের উপর নির্ভর করে ফলাফলের উপর নয়। এ প্রসঙ্গে কান্ট ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং ইচ্ছার পরাধীনতার মধ্যে পার্থক্য করেছেন।
মানুষের কাজ যখন কেবল সদিচ্ছা প্রণোদিত হয় তখন তার ইচ্ছা স্বাধীন, কেননা ঐ ইচ্ছা তার হৃদয়গ্রথিত , বাহ্য-আরোপিত নয়। পক্ষান্তরে, কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যসাধনের ইচ্ছা বশতঃ মানুষ যখন কাজ করে তখন তার ইচ্ছা পরাধীন, কেননা তখন সে বিশুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা চালিত না হয়ে বাইরের লক্ষ্যের আকর্ষণে চালিত হয়। কামনা-বাসনা প্রণোদিত কাজের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা পরাধীন। সদিচ্ছা প্রণোদিত ফর্মের ক্ষেত্রেই মানুষ স্বাধীন। সদিচ্ছা প্রণোদিত স্বাধীন কর্মই কেবল নৈতিক কর্ম।
২. কর্তব্যই কর্তব্যসাধনের লক্ষ্য: সদিচ্ছাকে কর্মনীতিরূপে গ্রহণ করলে কর্তব্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্যই কান্ট সুখবাদীদের ফলমুখী নৈতিকতাকে পুরোপুরি পরিহার করে কর্তব্যের নৈতিকতাকে গ্রহণ করেছেন। বিবেকের নির্দেশই হচ্ছে কর্তব্যের নির্দেশ। কান্টের মতে, সদিচ্ছা প্রণোদিত হয়ে বিবেকের নির্দেশে কর্তব্যের জন্য কর্তব্যসাধনই নৈতিক কর্ম।
ইন্দ্রিয়ানুভূতি, কামনা-বাসনা প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লক্ষ্য অর্জনের জন্য কর্ম কোন সর্বত্রব্যাপী নিয়ম অনুসরণ করে না, কেননা আবেগ, অনুভূতি প্রভৃতি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কিন্তু নৈতিক নিয়মকে সার্বত্রিক হতে হবে। ভিক্ষুককে দেখে করুণাবশত যদি কেউ তাকে ভিক্ষা দেয়, তাহলে সেই কাজকে ‘নৈতিক’ বলা যাবে না; কেননা অন্য কোন ভিক্ষুক দেখে তার মনে ঐ প্রকার করুণা-সঞ্চার নাও হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সে ভিক্ষাদান থেকে বিরত থাকতেও পারে। এইজাতীয় কর্ম যুক্তিহীন, কোন নিয়ম অনুসরণে করা হয় না। অধ্যাপক ব্ৰড্ (Broad) এইপ্রকার কাজকে ‘প্রবৃত্তিমূলক কাজ' বলেছেন।
নৈতিক কাজকে, কান্টের মতে, হতে হবে যুক্তিভিত্তিক, নিয়মভিত্তিক। কোন সেবা সংঘের কোন সদস্য যখন কোন সেবা প্রার্থীকে দান করতে চায়, তখন আবেগের দ্বারা চালিত না হয়ে বিচার-বুদ্ধিকে আশ্রয় করে এবং ঐ সংঘের দান-সংক্রান্ত নিয়মকে অনুসরণ করে দান করে অথবা দান করা থেকে বিরত থাকে। অধ্যাপক ব্রড্ এইজাতীয় কাজকে 'নিয়মভিত্তিক কাজ' বলেছেন। কান্টের মতে, প্রবৃত্তিমূলক কাজ বিকারগ্রস্ত কাজ। অর্থাৎ বিশুদ্ধবুদ্ধির বিকারজনিত কাজ। নৈতিক কাজকে হতে হবে নিয়মভিত্তিক।
কাজেই, কান্টের নীতিতত্ত্ব অনুসারে, স্নেহ, প্রেম দয়া-দাক্ষিণ্য ইত্যদির বশবর্তী হয়ে অনুষ্ঠিত কর্ম নৈতিককর্ম নয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐসব কাজকে ‘ভাল' বলা গেলেও, তাদের ‘নৈতিক ভাল’ বলা যাবে না। সমস্ত রকমের আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদিকে সংযত রেখে কেবল বিবেকের নির্দেশ অনুসারে কর্তব্যের জন্য কর্তব্যসাধনই হচ্ছে নৈতিক কর্ম।
৩. নৈতিক নিয়ম এক নিঃশর্ত আদেশ: প্রশ্ন হল, নৈতিক নিয়মের স্বরূপ কি! কান্ট নৈতিক নিয়মকে এক 'নিঃশর্ত অনুজ্ঞা বা আদেশ' বলেছেন, যা আমাদের ব্যবহারিক বিচারবুদ্ধি থেকে অর্থাৎ বিবেক থেকে নির্গত হয়। আমাদের অন্তর থেকে নির্গত হয় বলে, নিয়মটিকে আমরা সরাসরি জানতে পারি। ব্যবহারিক বিচারবুদ্ধি হওয়ায় নিয়মটি অভিজ্ঞতালব্ধ (empirical) নয়; তা আগেকার বা বিগত।
এই নৈতিক নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতির ওপরই কোন কাজের ভাল-মন্দ নির্ভর করে। নৈতিক নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতি থকলে কোন কাজ ‘ভাল', না থাকলে 'মন্দ'। মানুষের অন্তনির্হিত সুগভীর জ্ঞান থেকে নির্গত হয় বলেই নৈতিক নিয়ম প্রত্যেক মানুষের কাছে এক নিঃশর্ত অনুজ্ঞা বা আদেশরূপে দেখা দেয়।
ব্যতিক্রমহীন প্রাকৃতিক নিয়ম অন্যান্য সব নিয়মের ক্ষেত্রে এক প্রকার আদেশ বা অনুজ্ঞা প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র বা সরকারের নিয়ম জাতির কাছে আদেশসূচক, যা অমান্য করলে অমান্যকারীকে শাস্তি পেতে হয়। নৈতিক নিয়মের মাধ্যমেও এইজাতীয় আদেশ প্রকাশ পায়।
কান্টের নৈতিক মতবাদের সমালোচনা: একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, অন্য কোন নীতি-দার্শনিকের অভিমত কান্টের অভিমতের ন্যায় অপব্যাখ্যাত হয়নি। অধ্যাপক ব্রড্ ও একথা উল্লেখ করে বলেছেন কতকগুলি ক্ষেত্রে কান্টের মতবাদের যে ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে তা অতি সুস্পষ্ট। কান্টের নীতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রধান আপত্তির উল্লেখ করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা গেল-
১. কান্টের নৈতিক মতবাদকে ‘আকারসর্বস্ব' বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। ম্যাকেঞ্জি এই অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন কান্টের নিঃশর্ত অনুজ্ঞাসূচক নৈতিক নিয়মটির কেবল আকার আছে, উপাদান নেই। কেননা নিয়ম থেকে কোন বিশেষ কাজ আমরা করবো না (যেমন, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ না করা, মিথ্যা না বলা, চুরি না করা ইত্যাদি) তা নির্ধারণ করা গেলেও কোন কাজ আমাদের করা কর্তব্য তা নির্ধারণ করা যায় না।
কান্টের বিরুদ্ধে ম্যাকেঞ্জির এই আপত্তিটি সঠিক হয়নি। কান্ট ইচ্ছা পূর্বকই তাঁর নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নিয়মটিতে কেবল আকারেরই উল্লেখ করেছেন, উপাদানের নয়। নৈতিক নিয়মকে সার্বত্রিকরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কান্ট কোন বিশেষ কর্তব্যকর্মের উল্লেখ করেননি, কেননা বিশেষ কোন কর্তব্যনীতি সার্বত্রিক হতে পারে না। যুক্তিবিদ (Logician) যেমন কেবল বৈধ ন্যায়ের (valid syllogism) আকারের উল্লেখ করেন, কোন বিশেষ যুক্তির (argument) নয়, কান্টও তদ্রূপ সার্বিক নৈতিকবিধির আকারেরই উল্লেখ করেছেন, উপাদানের নয়।
অধ্যাপক ব্রড্ কান্টকে সমর্থন করে বলেন, 'যুক্তিবিজ্ঞানের কাজ যেমন কোন অনুমান বৈধ কি-না তা নির্ধারণ করার জন্য এক সার্বিক নিয়ম প্রবর্তন করা, তেমনি কান্টের নীতি-দর্শনেরও লক্ষ্য হল মানুষের আচরণ-বিধির ভালত্ব -মন্দত্ব নির্ণয় করার জন্য এক সার্বত্রিক নৈতিক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা।
২. কান্টের নিঃশর্ত অনুজ্ঞার বিরুদ্ধে ম্যাকেঞ্জি অপর এক অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন নিঃশর্ত অনুজ্ঞা বা আদেশের নিয়মটি পালন করতে আমরা যদি বাধ্য থাকি তাহলে নিয়মটিকে আর ‘উচিতার্থক’ বলা যায় না। যা আমরা অনুসরণ করতে বাধ্য তা আমাদের অনুসরণ করা উচিত। এমন কথার কোন অর্থ হয় না।
কোন নিয়ম বাধ্যতামূলক হলে তা উচিতার্থক নয়; তেমনি কোন নিয়ম উচিতার্থক হলে তা বাধ্যতামূলক নয়। নৈতিক নিয়ম যদি উচিতার্থক হয় তাহলে তাকে কোনভাবেই ‘বাধ্যতামূলক’ বলা যায় না। কান্ট নৈতিক নিয়মকে একইসঙ্গে ‘উচিতার্থক’ ও ‘বাধ্যতামূলক’ রূপে গণ্য করে স্ববিরোধী উক্তি করেছেন।
কান্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও যথাযথ হয়নি। কান্টের বক্তব্য হল— আমাদের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা যাকে উচিত বলে মনে করে তাকে অনুসরণ করতে বিচারশীল জীবমাত্রই দায়বদ্ধ থাকে। আমাদের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নৈতিক নিয়মটিকে পালন করা উচিত বলে নির্দেশ দেয় বলেই ঐ নিয়ম পালনে আমরা দায়বদ্ধ থাকি। নৈতিক নিয়ম উচিত। বলেই তা বাধ্যতামূলক।
৩. কান্টের নৈতিক মতবাদকে ম্যাকেঞ্জি আবার ‘অতি কঠোর’ও ‘অনমনীয়' কৃচ্ছ্রতাবাদ বলে অভিযুক্ত করেছেন। কান্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটিও যথাযোগ্য হতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, কান্ট তাঁর নৈতিক মতবাদের কোন ক্ষেত্রেই স্নেহ, প্রেম, দয়া-দাক্ষিণ্যকে হেয় প্রতিপন্ন করেননি; তিনি শুধু এটাই বলতে চেয়েছেন যে,
স্নেহ, প্রেম, দয়া-দাক্ষিণ্য বশত কোন কর্মকে ‘নৈতিক' বলা যাবে যদি ঐসব হৃদয়াবেগ কখনো অন্তর্হিত হলেও কর্মটি সদিচ্ছার দ্বারা, কর্তব্যবুদ্ধিতে, সম্পাদিত হতে পারে; অর্থাৎ অনুভূতি ও আবেগের সঙ্গে যদি সদিচ্ছা যুক্ত থাকে, তাহলে অনুভূতিবশত কর্মাদিকে ‘নৈতিক’ বলা যাবে। অপত্যস্নেহের সঙ্গে সদিচ্ছা যুক্ত থাকলে পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তানের সেবা-যত্ন ‘নৈতিক' বলেই প্রসংশিত হবে।
কর্মফলকেও কান্ট আগ্রহ্য করতে বলেননি। কান্টের অভিপ্রায় হল—ফলাফলের চিন্তা কখনো যেন কর্মকে নিয়ন্ত্রিত না করে, নৈতিক কর্ম পরিচালিত হবে কেবল সদিচ্ছার দ্বারা, কর্তব্যবুদ্ধিতে। ফলাফলের কামনা কর্মধারাকে নিয়ন্ত্রিত করলে অনেক অসৎকর্মও নৈতিকরূপে প্রতিষ্ঠা পায় এবং ফললাভের পর কর্মটিরও বিরতি ঘটে। কিন্তু কান্টের মতে নৈতিক কর্মের কোন বিরতি হতে পারে না, মানুষমাত্রই কর্ম করতে দায়বদ্ধ থাকে।
নৈতিকতাকে দায়বদ্ধ করতে হলে, সার্বত্রিকরূপে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, এজন্য, ফলাফলের চিন্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল সদিচ্ছার দ্বারাই কর্মসাধন করতে হয়, সেখানে ফলাফল যাই হোক না কেন। কান্টের এইপ্রকার অভিমতকে ‘অতি কঠোর’ বা ‘অনমনীয় কৃচ্ছ্রতাবাদ’রূপে অভিযুক্ত করা সঙ্গত হয় না।
৪. কান্টের নৈতিক মতবাদের বিরুদ্ধে অনেকে আবার অভিযোগ করে বলেন— কান্ট ইন্দ্রিয়বৃত্তির উচ্ছেদ ঘটিয়ে কেবল ব্যবহারিক প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হতে বলে মনঃস্তত্ব-বিরোধী অভিমত প্রকাশ করেছেন। কামনা-বাসনাই কর্মের উৎস। কামনা-বাসনার উচ্ছেদের সঙ্গে কমপ্রেরণারও উচ্ছেদ হলে সদিচ্ছার আর কিছুই ‘করার’ থাকে না।
জেকবি (Jacobi) এজন্য অভিযোগ করে বলেন—কান্টের সদিচ্ছা এক শূন্যগর্ভ ইচ্ছা মাত্র যার ‘করার' মত কিছুই থাকে না (A will that wills nothing)।
কান্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটিকেও সঠিক বলা যায় না। কান্ট কোন ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয়বৃত্তিকে বিনাশ করতে বা উচ্ছেদ করতে বলেননি। কান্ট মনস্তাত্ত্বিকদের মত সম্পূর্ণ সচেতন যে, পশুর মত মানুষের জৈব প্রবৃত্তি আছে। পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য হল, মানুষের উন্নত বিচারশক্তি আছে, যা পশুর নেই। এই পার্থক্যের জন্যই মানুষের নৈতিক জীবন থাকলেও পশুর নেই।
কাজেই, পশুর সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য মানুষের উচিত, উন্নত বিচারশক্তির দ্বারা তার পশু-প্রবৃত্তিকে সংযত করে জীবনে অগ্রসর হওয়া। কান্ট কেবল এটাই বলতে চেয়েছেন যে, মানুষ যেন তার ব্যবহারিক প্রজ্ঞার দ্বারা পশু-প্রবৃত্তিকে সংযত রাখে—না হলে পশুর সঙ্গে মানুষের প্রভেদ লুপ্ত হয়ে যায় এবং মানুষের নৈতিক জীবন' বলেও আর কিছু থাকে না। কান্ট ইন্দ্রিয়বৃত্তিকে কেবল সংযত করতে বলেছেন, উচ্ছেদ করতে বলেননি।
0 মন্তব্যসমূহ