বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের তুলনামূলক কৃতিত্ব বিচার কর।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ ধারা হলো 'বৈষ্ণব পদাবলী'।রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা মাহাত্ম্য বর্ণনাই বৈষ্ণব পদাবলীর মূল উদ্দেশ্য। চৈতন্য পূর্ব ও চৈতন্যোত্তর উভয় যুগের পদাবলী সাহিত্যের অজস্র কবিকুলের মধ্যে উজ্জ্বলতম দুটি নাম চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। বৈষ্ণবসাহিত্যে মৈথিল কবি বিদ্যাপতির যেমন জনপ্রিয়তা, বাঙালী কবি চণ্ডীদাসের অনুরূপ সমাদর রয়েছে।
বিদ্যাপতিকে বলা যায় সুখের কবি আর চণ্ডীদাস বলা,যায় দুঃখের কবি।কারণ চণ্ডীদাসের পদাবলীর সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে কৃষ্ণপ্রেমের জন্য রাধা- হৃদয়ের ব্যাকুল আর্তি আর যন্ত্রণার হাহাকার । সামন্ত সমাজের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এক বাঙালি গন্ডিবদ্ধ জীবনের নিরূপায় বন্দিত্ব, পরিবার- পরিজনের অরন্যে একাকিনী রাধা কখনও প্রেমের বেদনায়, কখনও গৌরবে আবারও কখনও বা নিজের দ্বিধান্দোলিত সত্তার ব্যাকুলতায় ব্যথাদীর্ণ চণ্ডীদাসের সমগ্র পদাবলী যেন সেই রাধার হৃদয় - নিংড়ানো অশ্রুবিন্দু দিয়ে গাঁথা মুক্তামালা।
ধূসর গোধূলির মতো ম্লান অসংজ্ঞেয় বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। পূর্বরাগ থেকে মাথুর এবং অবশেষে নিবেদন সর্বত্রই সেই সেই মুক্তাবিন্দুর শুভ্রতা, সেই বিষন্নতার গোধুলির ছায়া। এমনকি চণ্ডীদাসের রাধার মিলনেও সুখ নেই । কৃষ্ণকে আঁখির পলকে হারানোর বেদনায় তার মিলনানন্দ বিরহের অনুভবকেই জাগিয়ে তোলে -
"দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।"
অন্যদিকে বিদ্যাপতিকে বলা যায় সুখের কবি।বিদ্যাপতির পদে মিলনের উল্লাস,পূর্বরাগের সশঙ্ক ভীরু প্রেমজাগরণ, বিরহের বিচিত্র বেদনা সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে।প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায়গুলি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে ভাবোল্লাস পর্যন্ত প্রণয়ের যে নানা পর্ব সেগুলি শিল্পীর দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন এবং মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ ক’রে কিশোরী রাধার যৌবনে পদার্পণ এবং পরবর্তী কালে পূর্বরাগ অভিসার, মান ও ভাবোল্লাসের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। আবার কিছু পদে অন্তরের গভীরতাও প্রকাশ পেয়েছে।
"জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল।
সোই মধুর বোল শ্রবণ হি শুনলু
শ্রুতিপথে পরশ না গেল।।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই কবির পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন— “বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডীদাসের মিলনেও সুখ নাই বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডীদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন, বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডীদাস সহ্য করিবার কবি।
চণ্ডীদাস সুখের মধ্যে দুখ ও দুখের মধ্যে সুখ দেখিতে পাইয়াছেন। তাঁহার সুখের মধ্যেও ভয় এবং দুখের প্রতিও অনুরাগ। বিদ্যাপতি কেবল জানেন যে মিলনে সুখ, ও বিরহে দুখ, কিন্তু চণ্ডীদাসের হৃদয় আরও গভীর, তিনি উহা অপেক্ষা আরও অধিক জানেন”।
বিদ্যাপতি মিথিলার রাজসভার কবি।সেই ঐশ্বর্যময় অভিজাত জীবনের অলঙ্কৃত ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিময় তার কাব্য। এজন্য তাকে নাগরিক বা শহুরে কবি বলা হয়। শহর জীবনের নরনারীর যে বাক চাতুরাতা তার পদে উঠে এসেছে। তার পদে বিস্তৃত বর্ণণায় পরিশীলতা নাগরিকতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনের কবি । তিনি সহজতম ভাষায় প্রেমের গভীরতম আনন্দ বেদনার রূপকার বাংলার পল্লীজীবনের রূপ, রংও রস তার বর্ণবিরল সহজ প্রগাঢ় শ্যামলিমা নিয়ে চণ্ডীদাসের পদে উপস্থিত।
বিদ্যাপতির রাধা সাহসী। প্রেম ও কামনার উদীপ্ত উচ্ছ্বাসে কাজলের মতো অন্ধকার রাত্রিতে কৃষ্ণের অভিসারে যাত্রা করতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু চন্ডীদাসের রাধার ক্ষেত্রে ' ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশ ' যেন। লোকজ ভয়ে ভীত সে। শাশুড়ি, ননদ,স্বামীর ভয়ে ভীত সে। বর্ষণমুখর অন্ধকার রাত্রে কৃষ্ণ রাধার জন্য আঙিনায় ভিজতে থাকলেও রাধা পরিজনের ভয়ে তার সাথে মিলিত হতে পারে না।
চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি দুজনেই রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে পদ রচনা করেছেন। উভয়ের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম ভোগসর্বস্ব নয়। বিদ্যাপতির রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ের অনুরাগ সম্পূর্ণভাবে দেহকামনা নির্ভর।অন্যদিকে চণ্ডীদাসের রাধার অনুরাগে দেহভাব যেটুকু আছে তা তার নিবিড় গভীর অনুভূতিতে নিমজ্জিত ।
গঠনগত দিক থেকে বিদ্যাপতি খুব সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। ভাবের বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলার জন্য বিদ্যাপতি যেমন অজস্র শব্দপুঞ্জ ব্যবহার করেছেন, তেমনি নানা ঐশ্বর্যময় অলঙ্কারে ও তার কাব্যকে সাজিয়ে তুলেছেন।বক্তব্যের অপূর্বত্ব, উপমা, রূপকের বিচিত্র ব্যবহার, চিত্র সন্নিবেশের অজস্রতায় বিদ্যাপতির পদাবলী বাংলা ও মৈথিলি সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ। কৃষ্ণ রাধাকে চকিতের মধ্যে দেখে বলে ওঠেন—
"সজনী ভল কত্র পেখন না ভেল।
মেঘমালা মঁয়ে তড়িত লতা জনি
হিরদয়ে সেল দেই গেল।।"
মাঝে মাঝে আবার কাব্যের অলঙ্কৃতি তার কাব্যে অবয়বে কৃত্রিমতা ও আড়ষ্টতা এনে দিয়েছে । কিন্তু চনৃডীদাসের কাব্যে এ ধরনের আড়ষ্টতা নেই। চণ্ডীদাসের রাধার মতো চণ্ডীদাসের পদের ভাষা ও নিরাভরন, সহজ সরল অকৃত্রিম । তাই চন্ডীদাসের পদে বর্ণনার প্রাঞ্জলতা আর স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের ব্যবহার অন্তরের গভীরতম অনুভূতিকে সাবলীলভাবে প্রকাশ করেছেন ।
অলঙ্কারের বিন্দুমাত্র সাহায্য না নিয়ে ভাষার উচ্ছ্বাসকে বর্জন করে চন্ডীদাস হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি এবং চিত্তদীর্ণ ব্যাকুলতাকে মর্মস্পর্শী করে তুলেছেন। চণ্ডীদাসের পদে যেন একটি রং, সে রং বাংলার সহজ শ্যামলিমা, তার সমস্ত পদাবলীতে একটিই সুর, সেই সুর বিষন্ন বৈরাগ্যের সুর। অন্যদিকে বিদ্যাপতির পদাবলী যেন বিচিত্র তারের বীণা, তাই তাতে বিচিত্র ভাবের ঝংকার উঠেছে। জগদ্বন্ধু ভদ্র বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন -
" বিচিত্রভাব, অলঙ্কার, শব্দচাতুর্য,প্রকৃতিদর্শন প্রভৃতিতে বিদ্যাপতি অদ্বিতীয়। ইহার কল্পনার মধ্যে মধ্যে এমন গরীয়সী যে বোধ হয় তিনি যেন প্রকৃতির সমস্ত স্থল দর্শন করিয়াছেন।….চণ্ডীদাসের কবিতাদেবী নানা ভূষণে ভূষিত নহেন। হাব, ভাব, ভঙ্গি তত নাই আ,রূপে চক্ষু ঝলসাইয়া যায় না, কিন্তু স্বাভাবিক শোভিত।এই শোভা কেবল নয়ন মোহিত করিয়া ক্ষান্ত হয় না, হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তথায় থাকিয়া অন্তরাত্মাকে আনন্দরসে প্লাবিত করে । "
অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলীর দুজন কবি দুদিক থেকে অতুলনীয়। কাব্যশৈলির বিচারে বিদ্যাপতি যেমন অতুলনীয় তেমনি ভাবের গভীরতার দিক দিয়ে চন্ডীদাস এগিয়ে আছে।
বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে চন্ডীদাস এর কৃতিত্ব বিচার করা।কোন রস পর্যায়ে অনুভব তিলে তিলে নূতন হয়।বৈষ্ণব পদাবলী পদ pdf।চন্ডীদাস সমস্যা কী।চন্ডীদাসের কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।বিদ্যাপতির কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।বিদ্যাপতি কোন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি
0 মন্তব্যসমূহ