'মৃত্যক্ষুধা' উপন্যাসের মেজ বউ চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।

'মৃত্যক্ষুধা' উপন্যাসের মেজ বউ চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।


মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে একগুচ্ছ চরিত্রের উপস্থিতি থাকলেও নজরুল মূলত আনসার ও মেজো বৌ চরিত্রের মাধ্যমে তার আইডিয়া বা ভাবাদর্শকে রূপান্বিত করেছেন। বিশেষ করে মেজো বৌ চরিত্রটি উপন্যাসের দীর্ঘ পরিসরে পরিব্যাপ্ত এবং সে-ই পরস্পর-বিচ্ছিন্ন দুই কাহিনীর মৌল যোগসূত্র। 'মৃত্যু-ক্ষুধা'-র মেজবৌ চরিত্রটি নজরুলের চরিত্র-বিশ্লেষণ ক্ষমতার উজ্জ্বল উদাহরণ।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের বিষয়বস্তু।


মেজবৌ জীবন্ত এবং রক্তমাংসময় এক বিশিষ্ট চরিত্র। নজরুলের কথাসাহিত্যের মধ্যে গভীরতর অভিনিবেশে, এ-কথা বলা যায় মেজবৌ চরিত্রটিই একমাত্র সম্পূর্ণাঙ্গ নারী-চরিত্র। দরিদ্র এবং বস্তিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিত্ব, পরিমিতিবোধ, সংযম, তীক্ষ্ণধার বুদ্ধি, রুচিবোধ, বাস্তব জীবনদৃষ্টি সবকিছু মিলে নজরুলের এ-চরিত্রটি অন্য সবার থেকে আলাদা এক স্বতন্ত্র নারীর প্রতিমূর্তি বলা যায়, এই নারী নজরুলের মানসকন্যা। 



মেজবৌ তার চরিত্রের আকর্ষণী শক্তি দিয়ে সংসারের সকলকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই বড়বৌ তার সম্পর্কে বলে, 'সত্যি মেজবৌ, বড়ঘরে জন্মালে তুই জজ সাহেবের বিবি হতিস।' শাশুড়িও মেজবৌকে ভয় পেত, ভালোবাসত। তাই মেজবৌ সম্পর্কে তার মনোভাবনা:'কিন্তু মেজবৌকে কেন যে তার এত ভয়, কেন যে ওকে আর বৌদের মতো করে গালমন্দ দিতে পারে না, তা সে নিজেই বুঝতে পারে না।'

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের শিল্পমূল্য

মেজবৌ-এর রূপ বর্ণনায় নজরুলের সতর্কতাও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য—'দুঃখের আগুনে পুড়েও ও সোনা যেন এতটুকু মলিন হয়নি। বর্ষা ধোয়া চাঁদনীর মতো আজও ঠিকরে পড়ছে রূপ।' শাশুড়ির ভাষায় 'ও যেন একটি আগুনের খাপরা'। এ-জন্যেই সৌন্দর্য এবং বৈধব্য সত্ত্বেও পাড়ার বখাটেরা মেজবৌর দিকে হাত বাড়াতে সাহস পায়নি। বরং সহমিমতা-সহযোগিতায়,'ও যেন পাড়ার ছেলে-মেয়ে সব্বারই আদরের দুলালী মেয়ে।' অর্থের মোহে মেজবৌ রুচিকে কখনো বিসর্জন দেয়নি।


বিবাহলিপ্সু সচ্ছল ভগ্নিপতিকে বিবাহকরার পরিবর্তে পরিহাসে, তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে, ব্যঙ্গের খোঁচায় জর্জরিত করেছে মেজবৌ। খ্রিস্টান মিশনারীদের আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার সাহায্য-সেবা তাকে আকর্ষণ করেছিল। তাই সে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করে, 'শুকিয়ে মরলেও কেউ শুধোয়না এসে, ঝাঁটা মার নিজের জাতের মুখে। সাধে সব খেরেস্তান হয়ে যায়।'


মেজবৌ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ধর্ম ছাড়েনি, বরং জীবন-পিপাসার তীব্র টানেই সে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। তাই আনসারকে সে নিঃশঙ্কচিত্তে বলেছে, 'আমি ত হঠাৎ খ্রিস্টান হইনি। আপনারা একটু একটু করে আমায় খ্রিস্টান করেছেন।'সুতরাং স্বাধীন প্রাণচঞ্চল-জীবন-পিপাসু মেজবৌর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার অন্তরে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, তা অনুধাবনীয়। 


জীবনকে উপভোগ করায় মেজবৌ কোনো পাপ দেখেনি, জীবনের পিপাসাই তার কাছে অধিক মূল্য পেয়েছে। কারণ সে জানত, খ্রিস্টান হলে সে জ্ঞানচর্চা করতে পারবে, আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গে তার মন-মানসিকতাও হবে উন্নত। তাই মিস জোন্স যখন বলে, 'ডেখো, টোমার মটো বুদ্ধিমটী মেয়ে লেখাপড়া শিখলে অনেক কাজ করটে পারে।


টোমাকে ডেখে একটু লোভ হয় লেখাপড়া শেখাবার’, তখন মেজবৌর অন্তরে জাগে জ্ঞানতৃষ্ণার বুভুক্ষা। তাই মসজিদের আজান ধ্বনির কথা মনে ওঠায় অন্তরে পাপবোধ জাগলেও জ্ঞান-পিপাসার জন্য সে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হলো না। এ-প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য উদ্ধরণীয় :


'শুধু অর্থের প্রয়োজন পড়লে তার ভগ্নিপতিকে না হোক, অন্য কাউকে বিয়ে করে মেজবৌ সে চিন্তা থেকে রেহাই পেতে পারত। কিন্তু তার ইচ্ছা শুধু বাঁচার নয়, তার পিপাসা জীবনের। কুণ্ডলায়িত ঐ পরিবেশের মধ্যে আটকে থেকে তার বৃহৎ জীবনের মৃত্যু হচ্ছিল তিলে তিলে, সেই কঠিন নিষ্পেষণ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে, তার মতো মেয়ের জীবনের পক্ষে বায়ুহীন, রুদ্ধশ্বাস গৃহ থেকে উদ্ধার পাওয়ার প্রয়োজনে সে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। (নজরুল-সাহিত্য বিচার-শাহাবুদ্দীন আহমদ)


বাৎসল্য-প্রেম মেজবৌ-এর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার খোকার আত্মা চিরকালের ক্ষুধা নিয়ে যাতে ফিরে না যায়, শুধু এ জন্যেই সে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। অবশ্য, এ প্রসঙ্গে, এ-কথাও বলা প্রয়োজন, কেবল বাৎসল্য-প্রেমই তাকে ফিরিয়ে আনেনি। আনসারের প্রেম-ভালোবাসাও তাকে আকর্ষণ করেছে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে লতিফাও তাকে সংসারে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।


আনসার ও লতিফার সান্নিধ্য ও ভালোবাসা পেয়ে তার মধ্যে জাগলো সংসারে ফিরে আসার সুপ্ত বাসনা। অবশেষে এক সময় যে-সন্তানের জন্য তার সংসারে প্রত্যাবর্তন, সে মারা গেল; শূন্যতায় পূর্ণ হলো মেজবৌ-এর অন্তর। সন্তান হারানোর ব্যথা সে ভুলেছে দেশের অগণিত নিরন্ন শিশুর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে। এ-ভাবে মধ্যবিত্ত ঘরের এক বিধবা বধূ সংসারের সীমানা অতিক্রম করে সর্বজনীন মাতৃত্বের মহিমায় উন্নীত হয়েছে।


বস্তুত এই চরিত্রটিই নজরুলের অন্যতম সার্থক সৃষ্টি।উপন্যাসে প্রথামুক্ত বিধবা মুসলিম নারী হয়ে দুই সন্তানের জননী মেজো বৌ ধর্ম ত্যাগ করে অপরিচিত এক যুবকের প্রেমে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার যে দুঃসাহস দেখিয়েছে, তা বাংলা সাহিত্যে বিরলতম ঘটনা। বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের  উপন্যাস কৃষ্ণকান্তের উইল এর বিধবা রোহিণী;


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  চোখের বালির বিধবা বিনোদিনী কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রহীন  উপন্যাসের কিরণময়ীর মতোই মেজো বৌ প্রতিবাদী চরিত্র। তবে মেজো বৌ এদের তুলনায় আরও বেশি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী। যদিও মেজো বৌসহ উল্লিখিত প্রতিটি চরিত্রকেই সংশ্লিষ্ট লেখকের মানস প্রবণতা অনুযায়ী


সংস্কারবাদী চেতনার কাছে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। ঔপন্যাসিক নজরুলের মানবতাবাদী চেতনা ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মেজো বৌ তার বিদ্রোহকে পরিণতি দিতে পারে না। কিন্তু সে সমগ্র নারীজাতির জন্য প্রেরণা হয়ে তাদের দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তির লাঘবে বিদ্রোহের পথ দেখিয়ে দেয় । এজন্যই সমালোচক লিখেছেন :


'মেজ বৌ চরিত্রটি নানা দিক থেকে আকর্ষণীয়। নজরুল এই চরিত্রটি অঙ্কনে যেমন নারীর শারীরিক রূপ-রঙের ব্যবহার করেছেন, তেমনি অনেকগুলো গুণের সমাবেশও ঘটিয়েছে মেজ বৌ চরিত্রে। তার মাতৃরূপ, বধূরূপ, প্রেমিকারূপ, সব রূপ উজ্জ্বল দীপ্তিময় । বুদ্ধিমতী, বাকপটু আমরা দেখি উপন্যাসের শেষে মেজ বৌ হাজার শিশুর মা। '

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ