নববর্ষা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। নববর্ষা প্রবন্ধ।


নববর্ষা প্রবন্ধের মূলভাব ।


সুদীর্ঘ সাহিত্যজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)

নিজেকে বারবার কবি হিসেবে উচ্চকিত করেছেন সত্য, তবে তাঁর প্রতিভার বহুমুখ রশ্মি কথাসাহিত্য, নাট্যলােক, সংগীতাকাশ, এমনকি চিত্রলােককেও অসামান্য আলােকে উদ্ভাসিত করেছে। গদ্যও তাঁর প্রতিভার অন্যতম কষ্টিপাথর, 'গদ্যং কবীনাং নিকষং-বদন্তি।




রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌম কবি মনীষার উজ্জ্বল দীপ্তিতে তাঁর আর সব সাহিত্যকর্ম অপেক্ষাকৃত স্লান হলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ একটি উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হযেছেন। "বিচিত্র প্রবন্ধ"-এর অন্তর্গত "নববর্ষা" প্রবন্ধটি সম্পূর্ণরূপেই আবেগধর্মী মন্ময়তা-প্রধান একটি রচনা।


এই প্রবন্ধটির মধ্যে কবির একটি বিশেষ ভাবানুভূতি, ধ্যানদৃষ্টির একটি অতর্কিত উৎক্ষেপ, স্বপ্নাতুর কল্পনার একটি বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প অপরূপ কাব্যসৌন্দর্যের মাধ্যমে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। নববর্ষা প্রবন্ধের শুরুর দিকেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, "আষাঢ়ের মেঘ প্রতিবৎসর যখনই আসে তখনই তাহার নূতনদ্বে রসাক্রান্ত ও পুরানস্ব পুজীভূত হইয়া আসে। তাহাকে আমরা ভুল করি না, কারণ সে আমাদের ব্যাবহারের বাহিরে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের কালান্তর প্রবন্ধ।

আমার সংকোচের সঙ্গে সে সঙ্কুচিত হয় না।" অর্থাৎ, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যে নিত্য অভস্ত্যতা, চেনা গণ্ডি- সেই অভ্যস্ত গণ্ডি থেকে আমাদেরকে বের করে নিয়ে যায় এই মেঘ। আষাঢ় মাসের নতুন মেঘ আমাদের যে পুঞ্জীভূত পুরানত্ব সেটাকে তাড়িয়ে দেয়। সেই একঘেযে (monotonous) জীবন থেকে আমরা অকস্মাৎ পুরােপুরি বের হয়ে আসি। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ বলছেন- "মেঘ দখিলে 'সুখিনােহপ্যন্যথাবৃত্তিচেত:', সুখীলােকেরও আনমনা ভাব হয়।


মেঘ মনুষ্যলােকের কোন ধার ধারে না বলিয়া, মানুষকে অভ্যস্ত গণ্ডির বাইরে লইয়া যায়। মেঘের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনকার চিন্তা-চেষ্টা, কাজকর্মের কোন সম্বন্ধ নাই বলিয়া সে আমাদের মনকে ছুটি দেয়। মন তখন বাঁধন মানিতে চাহে না, প্রভুশাপে নির্বাসিত যক্ষর বিরহ তখন উদ্দাম হইয়া উঠে।" এই নববর্ষা প্রসঙ্গে "নববর্ষা" প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের "মেঘদূত"-এর কথা এনেছেন এবং স্বপ্রসঙ্গ বর্ণনা করেছেন।প্রবন্ধে পাই,


"মেঘে আমার কোন চিহ্ন নাই। সে পথিক, আসে যায়, থাকে না। আমার জরা তাহাকে স্পর্শ করিবার পায় না। আমার আশা নৈরাশ্য থেকে সে বহুদূরে। এইজন্য, কালিদাস উজ্জয়িনীর প্রসাদশিখর হইতে যে আষাঢ়ের মেঘ দেখিয়াছিলেন, আমরাও সেই মেঘ দেখিয়াছি, ইতিমধ্যে পরিবর্তমান মানুষের ইতিহাস তাহাকে স্পর্শ করে নাই।"


সুযোগ মেঘের যে জঙ্গমতা, মেঘের যে চলমানতা সেটি চিরায়ত। যে মেঘ কালিদাস দেখেছেন, সেই একই মেঘ আমরাও দেখছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও দেখবে। তাই কালে কালে প্রবাহমান এই মেঘ-সেটি চিরায়ত। তুলনার দর্পণে যদি দেখি, তবে দেখা যায়- পুরো স্থাপত্য হারিয়ে গেছে, একটি নগরী কালের বৈনাশিক সত্তার কাছে পরাস্ত হযেছে।


কিন্তু মেঘের প্রতি মেঘদূতের যে যাচনা বা মেঘকে কেন্দ্র করে তার যে অকারণ বিরহ; যক্ষ যক্ষপ্রিয়ার কাছে যে প্রেমের বার্তা পাঠাতে চাইছে, বিরহের বার্তা পাঠাতে চাইছে-সেটি চিরনতুন, চিরকালীন। এবং ব্যাবহারিক প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পর্কহীন এই মেঘ। ব্যাবহারিক জীবনে এই মেঘের সাথে কোন সংস্রব নেই। এটা চিরকাল মনকে ছুটে নেয় একটা অনির্দেশের দিকে। প্রাবন্ধিকের ভাষায়,


"আমার নিত্য র্মক্ষেত্রকে, নিত্যপরিচিত সংসারকে, আচ্ছন্ন করিয়া দিয়া সজলমেঘমেদুর পরিপূর্ণ নববর্ষা আমাকে অজ্ঞাত ভাবলােকের মধ্যে সমস্ত বিধিবিধানের বাহিরে একেবারে একাকী দাঁড় করাইয়া দেয়; পৃথিবীর এই কয়টা বৎসর কাড়িয়া লইয়া আমাকে একটি প্রকাণ্ড পরমায়ুর বিশালত্বের মাঝখানে স্থাপন করে...।


চিরকাল সেটি প্রযােজনের বাঁধ ভেঙে দেয়। চিরকাল সে অনির্দেশের সাথে আমরা মিলতে চাই। রাধা যেমন জীবাত্মার প্রতীক এবং কৃষ্ণ প্রতীক পরমাত্মার ; ঠিক তেমনি এই  অনির্দেশের দিকে ছুটে যাওয়া, এই মিলনের যে আকাঙ্ক্ষাটি-এটিকেই রবীন্দ্রনাথ যুক্ত করে দিতে চাচ্ছেন জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনের সূত্ররূপে। নিজেকে যদি জীবাত্মা হিসেবে মনে করি, তাহলে একটা অনির্দেশের দিকে যাত্রা-সেই যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ আসলে সেই পরম ভূমার সাথে মিলিত হতে চাইছেন।

রবীন্দ্রনাথের নারী প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।

চিরকালের যে পৃথিবী সে পৃথিবী নতুন হয়ে উঠে মেঘের গর্জনে। যেটা জানি সেটা তুচ্ছ মনে হয়, যেটাকে জানি না সেটাকেই মহার্ঘ মনে হয়। এবং তখন আমরা একা হয়ে যাই, আমাদের যে একাকীত্ব সেটিও চিরকালীন, আমরা নিত্যকালের ভাষায় চিরকালের কাব্য বলতে চাই। পূর্বমেঘে আমরা বহু বিচিত্রের সাথে মিলিত হতে চাই। কালিদাসের ভাষায়,

"...অনেক অনেক জনপদ পেড়িয়ে যাই...।"


কিন্তু উত্তরমেঘে আমরা একা, আমরা নির্জন ; এবং এই নির্জন সত্তাই যুক্ত হতে চায়- তার যে পরম ভূমা আছে।তার সাথে। সকল কবির কাব্যেরই গূঢ অভ্যন্তরে এই পূর্ববমেঘ ও উত্তরমেঘ আছে। সকল বড়াে কাব্যই আমাদেরকে বৃহত্ত-এর মধ্যে আহ্বান করে আনে ও নিভৃতের দিকে নির্দেশ করে। প্রথমে একটি বন্ধন ছেদন করে বাহির করে, পরে একটি ভূমার সাথে বেঁধে দেয়। "নববর্ষা" প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ  বলছেন,


" প্রভাতে পথে লইয়া আসে, সন্ধ্যায় ঘরে লইয়া যায়। একবার তানের মধ্যে আকাশ-পাতাল লইয়া সমের মধ্যে পূর্ণ আনন্দে দাঁড় করাইয়া দেয়।"


সুতরাং, ক্ষুদ্র সংসার বিসর্জন দিয়ে কবির ভেতর এই দুই মেঘই থাকে। এই চিরকালীন আবেদনটি মেঘদূত কাব্যের ভিতর দিয়ে এসেছে ; এবং প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ সেটিকে "নববর্ষা" প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং অপূর্ব সুষমায় পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।অতএব, আমরা বলতে পারি নববর্ষা প্রবন্ধে লেখকের চিরযৌবন ভাব ফুটে উঠেছে


নববর্ষা প্রবন্ধ মূলভাব। নববর্ষা প্রবন্ধের সমালোচনা। বিচিত্র প্রবন্ধ নববর্ষা। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ আলোচনা।বিচিত্র প্রবন্ধ সাহিত্য ও সৌন্দর্য চেতনা।রবীন্দ্র প্রবন্ধের বিষয় বৈচিত্র্য।বাজে কথা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ আলোচনা।রবীন্দ্র প্রবন্ধের বিষয় বৈচিত্র্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ