কালান্তর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু


কালান্তর প্রবন্ধের মূলভাব

'কালান্তর' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনে রচিত একটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ। এতে  সমকালীন বিশ্বরাজনীতি এবং  ভারতীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ ছাপ বর্তমান। ভারতীয় রাজনীতি তখন এক চরম সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চলছিল।এই সন্ধিক্ষণকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালান্তর নাম দিয়েছেন। কালান্তর প্রবন্ধে কালান্তর বলতে  ভারতবর্ষসহ সমগ্র বিশ্বের পরাধীন মানুষের  নবচিন্তার  সূত্রপাত বলে মনে করা হয়েছে। 



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  তার প্রথম  জীবনে ইউরোপ, তাদের শিক্ষা, সাধনা ও জ্ঞান সম্পর্কে  যে ধারণা করতেন  পরবর্তীকালে এসে  সেই ধারণার  রূপান্তর  ঘটেছে  এই কালান্তর প্রবন্ধে। ১৮৭৮ এবং  ১৮৯০ সালে তিনি  বিলেত  গিয়েছিলেন। প্রথম  জীবনে  ইংরেজি সাহিত্যের  ভেতর দিয়ে ইংরেজি শিক্ষা  ও সাহিত্যের যে মার্জিতমনা বৈদগ্ধের পরিচয় পেয়েছিলেন। বার্কের বাগ্মিতায়, মেকেলের ভাষা প্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে, শেক্সপীয়রের নাটক  আর বায়রনের কাব্যে তিনি  ইউরোপের সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পেয়েছিলেন।


১৯১৬ সালে তিনি  আমেরিকা  ও জাপান  গিয়েছিলেন এবং  যান্ত্রিকসভ্যতায় ও শিক্ষা, জ্ঞান সাধনায় তাদের অগ্রগতি লক্ষ্য করে  নিজেদের দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠেছিল। কিন্তু  ১৯২৪,১৯২৬,১৯২৯ সালে তিনি পুরো ইউরোপ ভ্রমণ করে তার মোহমুক্তি ঘটে । তিনি সেখানে দেখতে পান ইংরেজরা ভোগবাদের লালসায় কেমন করে  উন্মুক্ত চিত্তবৃত্তি থেকে সরে এসে, লোভের বর্শবতী হয়ে জীবনকে স্থবির করে  তুলেছে। 

ভারতবাসীর সামাজিক - রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক জীবনকে একাধিক কালে বিভক্ত করা যায়। প্রথম যুগ ছিল প্রাক মুসলিম যুগ। ভারতবাসীর জীবন তখন ছিল নিস্তরঙ্গ। বাইরের পৃথিবীর নানা সমস্যার থেকে তারা ছিল দূরে। চণ্ডীমণ্ডপে, বারোয়ারী তলায় বসে গল্প করে, যাত্রাপালা পাঁচালি দেখেশুনে তাদের সরল অনাড়ম্বর জীবন কেটে যেত। তারপর এলো মুসলমান শাসনের যুগ। এই শাসকরা নিজেরাই  ছিলেন প্রাচীনপন্থী , কাজেই  ভারতবাসীকে তারা কোনো নতুন সভ্যতার স্পর্শে নিয়ে আসতে পারে নি।


এর পরেই আগমন ঘটে  ইংরেজদের। ইংরেজদের  আগমনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  নব্য ইউরোপের চিত্তমুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখলেন। এসেই ভারতবাসীর চিত্তকে সর্বদিকে উন্মুক্ত করে দিল।তারা হয়ে উঠল ভারতের অন্তরঙ্গ। বাইরে থেকে আগত আর কোনো শাসকদল ভারতবাসীর চিত্তকে এমনভাবে  নাড়া দিতে পারে নি।ইউরোপ চিত্তের জঙ্গমশক্তি ভারতীয় চিত্তের স্থাবর ভূমিতে  ফলিয়ে তুলল জ্ঞান- বিজ্ঞান - সাহিত্যের নানা ফসল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় -


"য়ুরোপীয় চিত্তের জঙ্গমশক্তি আমাদের স্থাবর মনের উপর আঘাত করল,যেমন দূর আকাশ থেকে আঘাত করে বৃষ্টিধারা মাটির' পরে ;ভূমিতলের নিশ্চেষ্ট অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে প্রাণের চেষ্টা সঞ্চার করে দেয়,সেই চেষ্টা বিচিত্ররূপে অঙ্কুরিত বিকশিত হতে থাকে। "

সত্য সন্ধানী সততার বীজ  তারা আমাদের মধ্যে  রোপণ করে দিয়ে ভারতবাসীর জীবনে নিয়ে এলো জ্ঞানের বিশ্বরূপকে।জ্ঞানের রাজ্যে সবকিছুই যে মুক্তি শৃঙ্খলার অপরিহার্য বন্ধনে বাঁধা তা ভারতবাসীকে শেখালেন। তবে  ইংরেজদের সবচেয়ে বড় অবদান আইন - শৃঙ্খলার দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠায়, আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগে। উচ্চ - নীচ সব মানুষের  ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন আইনের  প্রবর্তন করেন তারা যা,আমাদের  পূর্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থায় ছিল না। মানুষের প্রতি মানুষের  অন্যায় দূর করে মানবতাবাদের শিক্ষা তারা দিয়েছেন এবং  মানুষকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার বিরোধিতা করেন।ইউরোপের সংস্রব ভারতবাসীর সামনে  এনে দিয়েছিল বিশ্বপ্রকৃতির কার্যকারণবিধির সার্বভৌমিকতা।


মার্টসিনি- গারিবালডি- গ্ল্যাডস্টোনের বজ্রকন্ঠে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ঘোষণায় ভারতবাসীর মনে  স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। ইংরেজ জ্ঞান, সত্য,সাহিত্য, স্বাধীনতা,মানবতা,ন্যায়- নীতির ধারক বলে ভারতবাসী ইংরেজদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠে এবং  এই আস্থার জোরেই তাদের মনে  আশ্বাস জাগে  - ইংরেজদের হাত ধরেই হয়তো তাদের স্বাধীনতা আসবে।  ইউরোপের চরিত্রের প্রতি  আস্থা নিয়েই নবযুগের সৃষ্টি হয়েছিল।কিন্তু  ভারতবাসীর নবজাগ্রত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দিতে তারা অস্বীকার করে, তাদের প্রবর্তিত মানবতাবাদকে তারাই লঙ্ঘন করে।


ইংরেজদের  ভোগবাদী  ও সাম্রাজ্যবাদী সত্তার কুৎসিত চেহারা দেখে  তখন  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপীয় সভ্যতার মোহ থেকে সরে  এলেন।ভারতকে তারা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত  করেছিল ঠিক কিন্তু  ব্রিটিশ পরাশক্তির সাম্রাজ্যবাদীর ভয়ংকর মুখোশে তারা আবৃত ছিল।তিনি  ইতিহাসের দিকে  মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন  বিভিন্ন দেশে তাদের  সর্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী রূপ  প্রকাশ পেয়েছে। 


যে ইউরোপের জ্ঞান ও বিজ্ঞান একদিন সমস্ত মানবজাতিকে পথ দেখাবে বলে ভারতবাসীর আশা ছিল সেই ইউরোপ  ডেকে এনেছে  পৃথিবীর বুকে ধ্বংসের তান্ডব। নিজেদের ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নখ- দন্ত বের করে ঝাপিয়ে পড়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে। মানবতার দূত হিসেবে যাদের  খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া  তারাই বিশ্বজুড়ে মত্ত হলো মানবতা লঙ্ঘনের খেলায়-

"ক্রমে ক্রমে দেখা গেল,য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয়মন্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্যে নয়,আগুন লাগাবার জন্যে। "


ভারতবর্ষেসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে তারা উপনিবেশ বানিয়ে  তাদের  লালসার পরিচয়  তুলে ধরে।চীনের আফিম যুদ্ধ(১৮৪০-৪২)তেমনই এক আগ্রাসনের চিত্র। কৌশলে চীনের মতো মতো বৃহৎ দেশকে পরাভূত করার জন্য চীনবাসীদের আফিমের নেশায়  আসক্ত করে তোলে। মায়া সভ্যতা,স্পেন থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একইভাবে ইংরেজরা নিজেদের মানবতাবিরোধী কর্মধারাকে বজায় রেখেছে  শক্তির মদমত্ততায়।সবশেষে  তাদের নগ্নচিত্তের প্রকাশ ঘটে  পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের জালিওয়ানবাগ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। 


সুতরাং আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা ইউরোপের যে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছিল,চিত্তমুক্তির প্রকাশ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বের জাগরণ যে জাতি সৃষ্টি করেছিল,কালক্রমে সেই জাতির  সাম্রাজ্যবাদী কদর্য রূপের প্রকাশ ঘটে। সভ্যতার এই সংকট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিমর্ষ করে  তোলে এবং  তার মোহমুক্তি ঘটে। আর এই মোহমুক্তির প্রকাশস্বরূপ তিনি  এই কালান্তর প্রবন্ধটি রচনা করেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ