মহুয়া পালার নাটকীয়তা।
'মহুয়া' গীতিকায় স্বাধীন মুক্ত প্রেমের জয়গান ঘোষিত।কবি পালাটিতে নদের চাঁদ ও মহুয়ার পরস্পরের প্রতি প্রেমের যে মনস্তত্বসম্মত বিকাশ ঘটিয়েছেন তা এক কথায় অপূর্ব। এই প্রেম-মনস্তত্ত্বের প্রকাশ 'মহুয়া' গীতিকাটিতে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে তা বাংলা সাহিত্যে সুলভ নয়। এই পালাই আকস্মিকতা ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা থাকায় কাহিনীতে কোন একঘেঁয়েমির জন্ম হয়নি।
স্বল্প পরিসরে সম্পূর্ণ 'মহুয়া' গীতিকাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রেম-মনস্তত্বের এক জীবন্ত ছবি পাঠকের কাছে অত্যন্ত বাস্তব রেখায় ফুটে উঠেছে। 'মহুয়া' পালাটি দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত 'মৈমনসিংহ গীতিকা'র একটি উল্লেখযোগ্য পালা। পালাটির সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে, পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক। রচয়িতা হিসেবে দ্বিজকানাই-এর নাম পাওয়া যায়। রসের দিক থেকে এটি রোমান্টিক ট্র্যাজেডি ঘরানার কাব্য।এটির রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল।
এই পালায় মোট ৭৮৯ টি ছত্র আছে। দীনেশচন্দ্র সেন 'মহুয়া' পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। এর প্রধান চরিত্রগুলো হলো- মহুয়া, নদের চাঁদ ও হুমরা বেদে। 'মৈমনসিংহ গীতিকা' এবং 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' তে যতগুলো পালা স্থান পেয়েছে তার মধ্যে সমালোচকগণ 'মহুয়া' পালাকেই শ্রেষ্ঠ গীতিকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একটি সফল গীতিকায় যা কিছু উপাদান থাকা দরকার 'মহুয়া' পালায় তা আছে। গীতিকার মধ্যে থাকে কাহিনী, চরিত্র, নায়ক-নায়িকার প্রেম।
মহুয়া পালার সমাজ চিত্রের পরিচয় দাও
প্রেমকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত; দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কেন্দ্র করে ঘটনায় আসে আকস্মিকতা, নাটকীয়তা। এছাড়াও 'মহুয়া' পালা সবচেয়ে জনপ্রিয় হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হল- পালাটির নাটকীয় প্রকাশ রীতি। পালাটিতে প্রচুর পরিমাণে নাটকীয়তা আছে। ট্র্যাজেডি ও নাটকীয় রূপ সমানভাবে প্রকাশ লাভ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, 'মহুয়া' পালাটি ট্র্যাজেডি হয়ে উঠার মূল কারণ হলো মহুয়ার সমগ্র জীবনে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি। কারণ মহয়ার ট্র্যাজিক জীবনটাই পুরো পালাটিকে ট্র্যাজেডিতে পরিণত করেছে যা পাঠকচিত্তে বিযোগান্তক বা করুণরস সৃষ্টি করেছে। নিচে বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল 'মহুয়া পালার শুরুতেই দেখা যায় অভাগা ব্রাহ্মণ শিশুকন্যা মহুয়া কে ডাকাত সর্দার হুমরা বেদে চুরি করে।
"ছয় মাসের শিশুকইন্যা সরসা সুন্দরী।
রাত্রি নিশাকালে হুমরা তারে করল চুরি।।"
[মহুয়া পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা]
এটা সত্য ধনীর নন্দিনী যদি চুরি না হতো নিশ্চিত সে বিলাসিতার সাথে জীবন-যাপন করে এক সময় যুবতী হয়ে উঠতো এবং কোন জমিদার বা দেওয়ান পুত্রের সাথে বিবাহিত হয়ে সুখে সমৃদ্ধিতে দাম্পত্য জীবন পার করত। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি, ফলস্বরূপ, চুরি হওয়ার জন্য মহুয়া বেদে বা যাযাবর জীবন লাভ করে যা মোটেও তার জন্য কাম্য ছিল না। এটা ছিল তার জীবনের বড় একটা ট্র্যাজেডি।
পরবর্তীতে যখন নদের চাঁদ ও মহুয়ার পরিচয় হয়, মহুয়া নিজের দুর্ভাগ্যের পরিচয় দিতে দিতে গিয়ে নদের চাঁদকে শুনিয়েই বলে এই দেশেতে এমন কেউ নেই যাকে সে তার 'পুরা মনের বেথা'র কথা ভরসা করে বলতে পারে। মহুয়া তার প্রেমিক নদের চাঁদকে পরম মমতায় আগলে রেখেছে। প্রেমিকের প্রতি প্রেমের তীব্র পরাকাষ্ঠা দেখিয়েও বুকে পাথর চেপে বলতে বাধ্য হয়েছে—
"আমি মরি জলে ডুব্যারে বন্ধু আমার মাথা খাও
ছাড়ান দিয়া আমার আশা ঘরে চল্যা যাও।।"
[মহুয়া পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা]
আসলে এ কথা বলে মহুয়া তার দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবনকেই কিন্তু নির্দেশ করেছেন। এবং সে জীবনে নদের চাঁদ জড়িয়ে তার মত ভালো মানুষের জীবন কেন সে প্রতিকূল ও জরাজীর্ণ করে তুলবে।
পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই, একদিকে প্রিয়-বিচ্ছেদ বেদনা অন্যদিকে 'বাপের সঙ্গে নাহি গেলে নাহি থাকব মান' এই দুইয়ের মাঝে পড়ে ক্ষতবিক্ষত মহুয়া কার্যত নদের চাঁদের প্রাণ রক্ষার্থেই বেদের দলের সঙ্গে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়। তবু বঁধুয়াকে নতুন স্থানের সন্ধান দিয়ে যেতে ভোলে না সে। মনে আশা যদি কোন একদিন তার কাছে ফিরে আসে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটি।
গীতিকার শুরুতে যে মহুয়ার অপরূপ রূপের ছটায় অন্ধকার ঘরেও আলো জ্বলতে দেখেছি এখন তার রং কালো হয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ, কি তীব্র বিরহ জ্বালা, তা বুঝতে আর আমাদের বিলম্ব হয়না। মৃতপ্রায় মহুয়া আবার আগের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায় নদের চাঁদ রূপী জিয়নকাঠির ছোঁয়ায়। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের পর যে মুহূর্তে মন প্রেমিকের সান্নিধ্য লাভে পরিতৃপ্ত হতে শুরু করেছে সেই ক্ষণেই পালক পিতার চরম নির্দেশ আসে মহুয়াকে নিজের হাতে ভিনদেশী যুবকের প্রাণ হরণ করতে হবে।
একদিকে পালক পিতার পিতৃঋণ পরিশোধের দায় অন্যদিকে প্রেমিকের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ—এই দুইয়ের মাঝে পড়ে সুন্দরী মহুয়া শুধু ক্ষত-বিক্ষতই হয়েছে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়নি তার—
"একবার দুইবার তিনবার করি।
উঠাইল নামাইল কন্যা বষরে ।। "
[মহুয়া পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা)
মহুয়া বুকে পাথর বেঁধে নদের চাঁদকে পরামর্শ দিয়েছে দেশে ফিরে গিয়ে 'সুন্দরী নারী' বিয়ে করে সংসারী হবার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় যদি আর কারে ভালবাস/ যদি আর ফিরে নাহি আস/ তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও আমি যত দুখ পাই গো।
সব কিছুর পরেও যখন নদের চাঁদ মহুয়ার প্রতি প্রেমে অবিচল থেকেছে তখন মহুয়া তার প্রেমিক তথা প্রেমকে বাঁচাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ঘোড়ায় চেপে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। সে হুমরা বেদের রক্তচক্ষুর আড়াল করতে নদী পার হতে গিয়ে আশ্রয়দাতা সাধুর লালসার শিকার হয়েছে। সাধু সওদাগর মহুয়ার রূপ দেখে পাগল হবে তাকে হীরা, মণি, উদয়তারা শাড়ি সহ আরো অনেক কিছুর বিনিময়ে হলেও মহুয়া কে ভোগ করতে চাই।
"দেখিয়া কন্যার রূপ সাধু পাগল হইল।
মাঝিমাল্লায় ডাক দিয়া সাধু সল্লা যে করিল।
[মহুয়া পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা]
সওদাগর, মাঝি-মাল্লাদের পাহাড়ি তক্ষকের বিষ, পানের সাথে মিশিয়ে দিয়ে মহুয়া নিজের সতীত্ব, মান- সম্মান রক্ষা করতে পারলেও রক্ষা করতে পারেনি পতি নদের চাঁদ কে। খরস্রোতা নদীতে ভেসে যায় তাঁর দেহ। নেমে আসে মহুয়ার জীবনে চরম দুর্ভোগ। এটাও মহুয়ার জীবনের বড় ধরনের একটি পরীক্ষা।
প্রেমের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে মহুয়া শত্রু হত্যায় পর্যন্ত পিছপা হয়নি। কিন্তু বিপদ একা আসে না। অসুস্থ নদের চাঁদ'কে সুস্থ করে দেওয়ার মূল্য হিসাবে গহীন বনে অবস্থিত মন্দিরের সন্ন্যাসী মহুয়ার যৌবন কান্না করে-
"তোমার রুপেতে আরে কন্যা যোগীর ভাঙ্গে যোগ।
এমন ফুলের মধু করাও মহর ভোগ।।"
শিশুকাল থেকে বিপদসঙ্কুল জীবন অতিবাহিত করার ফলে মহুয়া অনেক বেশি বিপদ সম্পর্কে সচেতন। দেহের বয়স কম হলেও মনের দিক থেকে সে অনেক বেশি পরিণত। বাস্তববোধ সম্পন্না নারী। মহুয়া সন্ন্যাসীকেও রাজী করায় অত্যন্ত সুচারু রূপে। পরে সন্ন্যাসীর হাত থেকে বাঁচাতে অসুস্থ স্বামীকে কাঁধে তুলে নিতে পিছপা হয় না সে । জীবনকে বাজী রেখে প্রতিনিয়ত এককঠিন অসম লড়াই করতে হয়েছে মহাকে এবং এই লড়াইটা তাকে একাই লড়তে হয়েছে।
বস্তুত, এক্ষেত্রে নদের চাদঁকে আমরা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখি। মহুয়ার সংগ্রামী জীবনে এরপর কয়েকটা দিন আসে সুখের পারাবারে ভেসে বেড়াবার জন্য। তাদের বন্যদাম্পত্যের ছবিটি পল্লী কবির লেখনীতেও অসাধারণত্ব লাভ করেছে। প্রেমিকের সামান্যতম আঘাতেও বিচলিত হয়ে ওঠে মহুয়ার হৃদয়। কিন্তু তাদের এই সুখও ছিল স্বল্প স্থায়ী। পালং সইয়ের বাঁশি আর শিকারী কুকুরের উপস্থিতিতে শিরেতে পড়িল বাজ এই অকরসাত। শুরু হয় পাঠক চিত্তে ভয় ও অনুকম্পা। নিজের জীবন বাঁচাবার শেষ সুযোগটি মহুয়াকে আরো একবার অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন করে তোলে।
হুমরার বেদের ভাই মাইনক্যার পুত্র সুজন খেলোয়াড়কে বিয়ে করতে হবে। প্রেমের প্রাথমিক পর্বে যে কঠিন বাধা মহুয়া অতিক্রম করেছে তার কাছে এ প্রস্তাব অতি তুচ্ছ। যখন মহুয়া দেখল নিজেকে বাঁচানোর ন্যূনতম সুযোগটিও আর নেই একমাত্র তখনই সে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হল। পিতৃ আদেশে প্রাণপ্রিয়কে হত্যা করার পরিবর্তে চুরির আঘাতে নিজের হৃদয় বিদীর্ণ করল সে
"কেমনে মারিব আমি পতির গলায় ছুরি।
খারা থাক বাপ তুমি আমি আগে মরি।।"
ভাগ্যের নিষ্ঠুর এই পরিহাসে বিপর্যস্ত মহুয়া মর্মান্তিক হাহাকারে তার পালক পিতার উদ্দেশে তার শেষ প্রতিবাদ জানায়। এরপর নদের চাঁদ ও সুজন কর্তৃক হত্যার স্বীকার হয়। এভাবেই সহার বিষাদময় ট্র্যাজিক জীবনের সমাপ্তি হয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, মধ্যযুগের দৈবী নির্ভর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক পরিবেশে একাকী নারী মহুয়া আজীবন ভাগ্যের নিষ্ঠুর চক্রাবের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামী চরিত্রের জন্য চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। যার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল— 'না নিব না দিব পরাণ আরও দেখি শুনি।' অর্থাৎ জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য সে তার মৃত্যুঞ্জয়ী মনোভাব নিয়ে আপ্রাণ লড়াই করে। গেছে।
'মৈমনসিংহ গীতিকা'র অন্যান্য নায়িকা চন্দ্রাবতী বা মলুয়ার তুলনায় মহুয়া স্বাতন্ত্র্য বা ভিন্ন। সংগ্রামশীলতা, ভাগ্য বিড়ম্বনা, বার বার কঠোর পরীক্ষা আর বিষাদময় জীবনের করুণ পরিণতি মহুয়ার অন্তরাত্মা কে পুড়িয়ে যেন কয়লা করে ফেলেছ। যার ফলস্বরূপ 'মহুয়া গীতিকাটিতে নাট্যরূপ প্রকাশ পেয়েছে।
মহুয়া চরিত্রের দুটি বৈশিষ্ট্য।ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া চরিত্র।মহুয়া পালার শিল্পমূল্য। মহুয়া পালায় মহুয়ার চরিত্র আলোচনা কর।মহুয়া চরিত্র বিশ্লেষণ।মহুয়া চরিত্র।মহুয়া পালায় মহুয়ার চরিত্র।মহুয়া পালার গুরুত্ব আলোচনা করো।মহুয়া পালার কাহিনী।মহুয়া পালার নাট্যরূপ।
0 মন্তব্যসমূহ