শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নাটকীয়তা।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নাট্য লক্ষণ।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মধ্যযুগের প্রথম কাব্য এবং এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস মধ্যযুগের আদি কবিভাগবত প্রভৃতি পুরাণের কৃষ্ণলীলা-সম্পর্কিত কাহিনি অনুসরণে, জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের প্রভাব স্বীকার করে,লোকসমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ প্রেম সম্পর্কিত গ্রাম্য গল্প অবলম্বনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য রচনা করেন

১৯০৯ সালে (১৩১৬  বঙ্গাব্দে) বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে  এক গৃহস্থ বাড়ির গোয়ালঘর থেকে  পুঁথি আকারে অযত্নে রক্ষিত এ কাব্য আবিষ্কার করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন  অধ্যায়ের সংযোজন ঘটান।মূলত রাধা ও কৃষ্ণের অপার প্রেম কাহিনি সামনে রেখেই এ কাব্য রচিত হয়েছে।গল্পটি সংলাপে মাধ্যমে টেনে নিয়ে গেছে।



এ কাব্যের প্রধান তিনটি চরিত্র  - রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই। শরীরী প্রেমের রিরংসতপ্ত আর্তি ও হাহাকার , প্রাপ্তি ও অচরিতার্থ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, রতি ও আরতি এখানে  বাস্তব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।  আপাত দৃষ্টিতে রাধা ও কৃষ্ণকে আমরা পরমাত্মা হিসেবে জানলেও এ কাব্যে রাধা কৃষ্ণকে স্বাভাবিক মানুষ অর্থাৎ জীবাত্মা রুপেই চিত্রিত করা হয়েছে

রাধার প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগ, তাতে রাধার বাধ সাধা এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণ বিরহে রাধার ব্যাকুলতা এ কাব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছেঅর্থাৎ দেবলীলা নয়,মানবলীলাই এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে।ডমোট ১৩ টি খন্ডে পুরো কাব্যটিকে বিভাজন করা হয়েছেশ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি সংস্কৃতের গীতগোবিন্দের অনুরুপ গীতি এবং সংলাপ বহুল নাট্যলক্ষ্ণাক্রান্ত রচনা বলে তা নাট্য গীতিকাব্য হিসেবে আখ্যাত হয়েছে

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ।

কাব্যটি ঘটনা বিবৃতি, নাট্যরস গীতিরস -এই তিন বৈশিষ্ট্য নিয়ে রূপায়িত হয়েছেতবে ঘটনা গীতিরস অপেক্ষা নাট্যরসের প্রাধান্য বেশিশ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাট্যগুণে অনন্য একটি রচনা । নাটকের রূপলক্ষণ ও উপকরণাদি এ কাব্যে সহজলভ্য। এ কাব্য কাহিনিকাব্যের আকারে গ্রন্থিত হলেও প্রকারে রীতিমতো নাটক যার পর্বে পর্বে নাটকীয়তার সমাবেশ লক্ষ করা যায়, পদে পদে  নাট্যরসের প্রবল সিঞ্চন দেখা যায়।

যে পদগুলোতে  একাধিক চরিত্রের সংলাপ আছে  সেখানে নাটকীয়তার প্রকাশ  সর্বাধিক।এ কাব্যের সংলাপগুলো চরিত্রানুগ,তাদের  মুখের ভাষা বুকের ভাবনারই অবিকল  উচ্চারণ। খন্ডে খন্ডে চরিত্রগুলো যখন  পরিবর্তন হয়েছে  সচেতন কবি  সাথে সাথে  চরিত্রের  সংলাপ  ও বদলে  চলেছেন। স্থানীয় পরিবেশ নির্মাণে ও গল্প  বয়নে কবির বিবৃতি  ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চরিত্রের অঙ্গভঙ্গি নির্দশনায় কবি একজন  দুর্দান্ত নির্দেশক এর ভূমিকা পালন করেছেন। 


 নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংলাপ।  এ কাব্যে আমরা একাধারে একক এবং দ্বিপাক্ষিক-সংলাপের প্রাধান্য দেখতে পাইরাধা,কৃষ্ণ, বড়ায়ি,রাধা-কৃষ্ণ,রাধা-বড়ায়ি কৃষ্ণ-বড়ায়ির কথোপকথনের মাধ্যমেই পুরো কাব্যটি গতিশীল হয়েছেসংলাপ থাকলে সেখানে নাটকীয়তার আবেশ থাকবে এটা খুব স্বাভাবিকসেদিক বিবেচনায় কাব্যটিও নাট্যধর্ম বহির্ভূত নয়জন্ম খন্ড বাদ দিলে পরবর্তী সবগুলোই খন্ডেই আমরা সংলাপের প্রাচুর্য দেখতে পাই

        "সুণহ সুন্দরী রাধা বচন আক্ষ্মার

        যমুনাক যাই ছলে পাণী আনিবার।।

        তোক্ষ্মার বচনে যমুনাকে আক্ষ্মে জাইব

        তথাঁ গেলেঁ কেমনে কাহ্নাঞিঁর লাগ পাইব।।"


রাধা বড়ায়ির উক্ত কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে আমরা একধরনের নাটকীয়তা লক্ষ করিকৃষ্ণকে খোঁজার জন্য পানি আনার ছলে যমুনাতে যাওয়ার ব্যাপারটি বেশ নাটকীয় বলেই মনে হয়তাম্বুলখন্ডে আমরা বড়ায়ি কর্তৃক রাধার রুপ বর্ণিত হয়েছেএক্ষেত্রে বড়ু চণ্ডীদাস চাইলে বিবৃতির মাধ্যমে রাধার রুপ বর্ণনা করতে পারতেন


কিন্তু এখানে একধরনের নাটকীয়তার আবেশ আনবেন বলেই হয়তো তিনি বড়ায়ি কৃষ্ণের দেখা করালেনএবং অনায়াসে বড়ায়ির মুখে রাধার রুপ বর্ণনা করলেন। অর্থাৎ রাধাকে কৃষ্ণের সামনে উপস্থিত করার জন্য কবি নাটকীয় কৌশল গ্রহণ করেছেন। কৃষ্ণের নিকট রাধার রূপ বর্ণনা করার প্রয়োজনেই কবি আগে থেকেই নাট্যগুণ সমন্বিত পটভূমির সৃষ্টি করেছেন। বড়ায়ির মুখে রাধার রূপের  বর্ণনা শুনে কৃষ্ণের উক্তি -


" তোর মুখে রাধিকার রূপকথা সুনী।

ধরিবাক না পারি পরাণী।বড়ায়ি লো।।"


সংলাপকে স্বাভাবিক ও নাটকের উপযোগী করার জন্যই অন্ত্যমিলের পর 'বড়ায়ি লো' উক্তিটি করেছেন। 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনির মধ্যেই আমরা একধরনের নাটকীয়তা লক্ষ করিরাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের মামী হয়মামীর সাথে কৃষ্ণের অবৈধ প্রণয় কোনভাবেই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত নয়তথাপি কবি ক্রমশ এই প্রণয়কে ঘনীভূত করে একধরনের নাটকীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছেন-


"এ বোল বুলিতে কাহ্ন না বাসসী লাজ।

তোহ্মার মাঊলানী আহ্মে শুন দেবরাজ।।

হইএ আহ্মে দেবরাজ তোহ্মমে মোর রাণী। 

মিছাই সম্বন্ধটি  পাত ভাগিনা মাঊলানী।।" (দানখন্ড)


নাটকের অন্যতম প্রধান গুণ বাস্তবধর্মীতা।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নায়ক - নায়িকার দ্বন্দ্ব কলহ, তাদের মন মেজাজের উত্তাপ,প্রথমে  দৃঢ় অসম্মতি ও পরিণামে আত্মনিবেদনের ব্যাকুলতা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে  বড়ু চণ্ডীদাস মানব প্রকৃতিকে করে   তুলেছে বাস্তবধর্মীতাছাড়া চরিত্রগুলোর সহজ সরল প্রাণবন্ত কথোপকথনে চরিত্রগুলোও হয়ে উঠেছে জীবন্ত

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা চরিত্রের বিশ্লেষণ।

একটি  নাটকের  প্রধান প্রাণ হলো নাট্যিক দ্বন্দ্ব । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এই নাট্যগুণ বহির্ভূত নয়। কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি এই তিন চরিত্রের মধ্যে  রাধা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য নাটকীয় চরিত্র । নাটকের চরিত্রগুলো নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয় সর্বোপরি বিভিন্ন প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব সংঘাত  নাটকীয়  চরিত্রকে নবনব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত  পরিণতির অভিমুখে  নিয়ে  চায়। এ কাব্যে রাধা চরিত্রের মধ্যে  আমরা এ ধরনের  বিবর্তন দেখতে পাই।কাব্যের শুরুতে যে রাধা কৃষ্ণবিরাগে আচ্ছন্ন, কাব্যের শেষে  সেই  রাধাই কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদ,ব্যাকুল, উন্মুত্ত-


"মোঞঁ সে দগধকপালী। 

নাম মোর চন্দ্রাবলী। 

আন মোর নাহিঁ গতী

ছাড়িআঁ প্রিয় বনমালী।।"

( রাধা বিরহ খন্ড) 


এছাড়া একটি নাটকের যে সকল গুণগুলো নাটক হয়ে পার জন্য জ্বরুরি তার প্রায় সবগুলোই কাব্যে বিদ্যমানআরম্ভ,ক্রমবিকাশ,চূড়া,গ্রন্থিমোচন উপসংহার এই স্তর গুলোর প্রায় প্রতিটিই যথোচিতভাবে কাব্যে এসেছেমূলত কাব্যের ৪১৮ টি পদের মধ্যে গোটাকয়েক পদে বাদ দিলে কাব্যকে নাট্যকাব্য বলা চলে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা' গ্রন্থে  বলেছেন --

"বড়ুচন্ডীদাস গ্রাম্য সমাজের জন্য তাঁহার  কাব্য লিখিয়াছিলেন বলিয়া ইহার মধ্যে নাটকীয়তা আরও তীক্ষ্ণভাবে প্রকট হইয়াছে - ইহার কাব্যগুণকে ছাড়াইয়া  ইহার নাট্যগুণই প্রধান হইয়া উঠিয়াছে। "


 প্রাচীন বাংলা  গীতিকবিতার কাঠামো  এখানে  নিহিত  আছে  বলে  এ কাব্যে গীতিময়তাবও লক্ষ করা যায়। সমালোচকেরা এ কাব্যে গীতিকবিতার সৌন্দর্য যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন,  তেমনি লক্ষ করেছেন পদাবলীর আদল ও গীতময় লালিত্য।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি মূলত নাটকের পাত্রে সঙ্গীতের পরিবেশনা।প্রাচীন গীতিকবিতার লক্ষণ বহন করে এ কাব্য আধুনিক  গীতিকবিতার ধর্মকে স্পর্শ করেছে। একটি পুর্ণ কাব্যের অংশ হিসেবে  নয়, এ কাব্যের কিছু পদ গীতিকবিতা হিসেবে মূল্যবান।    গীতিনাট্য বিবৃতির মিশেলে রচিত  এ কাব্যে কিছু কিছু  পদে  গীতময়তা লক্ষ করা যায়। যেমন রাধার হৃদয়ের আর্তি প্রকাশে-


"কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ী কালিনী নই কূলে।

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।"


 সবশেষে আমরা বলতে পারি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি নাটকীয়তা ও  গীতময়তার সমন্বয়ে  নাট্যগীতি হিসেবে  বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে । 


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের গীতিময়তা।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সাহিত্যমূল্য।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নাটকীয়তা।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সমাজচিত্র। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নাট্য লক্ষণ।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের গঠন বৈশিষ্ট্য।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবিক আবেদন।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা।

কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ