দেওয়ানা মদিনা পালার শিল্পমূল্য বিচার কর।

  'মৈমনসিংহ গীতিকা'র একটি উল্লেখযোগ্য পালা 'দেওয়ানা মদিনা'। 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটির প্রাথমিক সংগ্রাহক হিসাবে চন্দ্রকুমার দে ও পরবর্তীতে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক এর নাম পাওয়া যায়। পালাটির সম্পাদনা করেন দীনেশচন্দ্র চন্দ্র সেন। পালাটি রচনা করেন মনসুর বয়াতী। 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটিকে কেও কেও 'আলাল দুলালের পালা' হিসাবেও অভিহিত করেন। 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটি কতটা শিল্প সম্মত হয়ে উঠেছে, তা বিচার বিশ্লেষণ করবার আগে আমাদের জেনে নেয়া প্রয়োজন একটি গীতিকার শিল্প সাফল্য লাভ করতে হলে কি কি গুণাবলী থাকা প্রয়োজন।




একটি সার্থক গীতিকার মধ্যে যা যা থাকে তা হলো একটি আকর্ষণীয় কাহিনী, কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, চরিত্রকে অবলম্বন করে কাহিনীর উত্থান পতন, জীবনের নানা বৈচিত্র্য দিক, নাটকীয়তা, সমাজের নানা চিত্র, নায়ক-নায়িকার প্রেম, সেই প্রেমকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা, ঘটনা বিন্যাসে সংযম, কাহিনীর গতিশীলতা, হৃদয় বৃত্তি, প্রকৃতি, ভাষা, শব্দ, ছন্দ, উপমা, অনুপ্রাসের সার্থক প্রয়োগ, সবকিছু মিলেই একটি গীতিকার শিল্প সাফল্য আসে। আমরা এসবের মাপকাঠিতে 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটির শিল্প সাফল্য পর্যালোচনা করতে পারি।


দেওয়ানা মদিনা পালার কাহিনি বিশ্লেষণ।

'দেওয়ানা মদিনা' পালার শুরুতেই রয়ে গেছে একটি হৃদয়স্পর্শী, আবেগ মাখা করুণ নাটকীয় কাহিনি। যেটা পুরো পালার কাহিনি কে করে গতিশীল ও প্রাণবন্ত। সোনাফর দেওয়ানের স্ত্রী মৃত্যু শয্যায় শায়িত, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে যে দুঃশ্চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তা হল তার কোলের দুই সন্তান আলাল ও দুলালের ভবিষ্যৎ । নিজের মৃত্যুর জন্য তার কোন দুঃখ নেই, তার সমস্ত দুঃখ আর দুশ্চিন্তা আলাল এবং দুলালকে নিয়ে। আলাল-দুলাল তার কলিজার টুকরা, তার মৃত্যুর পর সংসারে যদি তাদের সৎ মা আসে, সেক্ষেত্রে আলাল-দুলালের পরিণতি কি হবে সে কথা ভেবে মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে আলাল-দুলালের ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের যন্ত্রণা অধিক।


আপাতভাবে মনে হবে ঐ রমণী মৃত্যুর পরেও এইভাবে তার প্রিয়তম স্বামীর ওপর নিজের অধিকার কায়েম রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত, কোন নারীর সঙ্গে তার স্বামীর সংসর্গ সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, এমনকি তার মৃত্যুর পরেও নয়। কিন্তু ক্রমশ প্রকাশ পেয়েছে যে রমণীটির অনুরোধের কারণ অন্যবিধ। দু-দুটি শিশু সন্তান সে রেখে যাচ্ছে, পাছে বিমাতার দ্বারা তারা নির্যাতিত হয় এই ভার ভয়


"সতীন বালাই কিরা কই তোমার কাছে।

এ ভিন ধরেনা মোর দুঃখু পাইব পাছে।।

সতীনের ছাওয়াল কাঁটা সভাই মায়ে লাগে।

সেই না কাঁটা তুলে সভাই সগলের আগে।। "

['দেওয়ানা মদিনা' পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা]


প্রকৃতপক্ষে, এতোকিছুর অন্তরালে রয়েছে মাতৃস্নেহ। সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ, মমতা, ভালবাসা। যা মানব জন্মের আদিকাল থেকে অব্যাহত গতিতে চলছে। এর শেষ নেই, সীমা নেই। সবদেশে, সবকালে, সকল জাতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই মাতৃস্নেহ অভিন্ন। এই অভিন্ন বিষয়টিকে লোককবি 'দেওয়ানা মদিনা' পালায় চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবির এ বর্ণনা হৃদয়স্পর্শী এবং এর আবেদন সার্বজনীন ও চিরন্তন।


দেওয়ান সোনাফর এর অবস্থা খারাপ হয় তখনই যখন দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করে। ফলে তার দুটি নাবালক সন্তানের জীবন চরম বিড়ম্বনায় পৌছে, আর বিড়ম্বনার মূলে দেখা গেছে তার দ্বিতীয় পত্নীকে। আলাল, দুলালের জননী কথিত কবুতর কাহিনীর দ্বিতীয় কবুতরীর বিশ্বাসঘাতকতা সোনাফরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়েছে।


"মরাত না গেছ আওরাত গিয়াছ মারিয়া।

তিনলা পরানি মারা গেছে পলাইয়া।।"

[দেওয়ানা মদিনা' পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা]


আসলে, উপর্যুক্ত বিষয়টি পাঠকের হৃদয়কেও দ্রবীভূত করে। মাতৃহীন দুটি নাবালক সন্তানকে নিয়ে বান্যাচঙ্গের দেওয়ানের যে বিপত্তি ঘটেছে, তা বাস্তবিকই অতিশয় মর্মান্তিক। যোগ্য কর্ত্রী না থাকলে সংসার মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়। এই বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই তো সোনাফর দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছে। কবি নিপুণভাবে সোনাফরের দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পটভূমিটি অঙ্কিত করেছেন।


বান্যাচঙ্গের দেওয়ানের দ্বিতীয় স্ত্রী সতীন পুত্রদ্বয়ের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করেছে তা যেমন ঘৃণ্য তেমনি অতিশয় হৃদয়হীন, কিন্তু এক্ষেত্রেও আলাল-দুলালের প্রতি দেওয়ানের অতিরিক্ত মনোযোগ দান এবং দ্বিতীয় পত্নীকে অবহেলার কারণে দ্বিতীয় পত্নীর সতীন পুত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মানসিকতা গড়ে ওঠার সূক্ষ্ম মনস্তাত্বিক দিকটি অনবদ্যভাবে রূপায়িত করেছেন কবি।


সতীন পুত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে সোনাফরের দ্বিতীয় স্ত্রী অত্যন্ত কৌশলে গোপনে যে ষড়যন্ত্র গড়ে তুলেছে, আখ্যানটিতে তা এক অতিরিক্ত মাত্রা সংযোজন করেছে। এ ব্যাপারে জল্লাদের সাহায্য গ্রহণ- আখ্যানের এই অংশে রোমাঞ্চকর করুণ পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে।


উপকাহিনি।

কাহিনীতে যত শাখা প্রশাখা গজায়, কাহিনী তত গতি হারায়। 'দেওয়ানা মদিনা' পালার শুরুতে একটি শাখা কাহিনি (কবুতর কাহিনি) থাকলেও পরবর্তীতে আর কোন শাখা কাহিনি গজায় নি, এতে কাহিনির মধ্যে গতি সঞ্চারিত হয়েছে, যা গীতিকার একটি বৈশিষ্ট্য। কবি কোনো কিছুর বর্ণনা দিতে গিয়ে অত্যন্ত সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় বাক্য দিয়ে কাহিনিটিকে ভারাক্রান্ত করে তুলেননি বরং অতি সংক্ষিপ্ত বাক্যে অনেক বড় ভাব প্রকাশ করতে পেরেছেন। এটি কবির শিল্প চাতুর্য। 'দেওয়ানা মদিনা' পালায় কবি এমন কিছু শব্দ উচ্চারণ করেছেন যা হৃদয়কে গভীর ভাবে আলোড়িত করে।


যেমন- দুলাল চলে যাওয়ার পর মদিনা তার পথ চেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।


"আইজ বানায় তালের পিডা কাইল বানায় থৈ।

ছিক্কাতে তুলিয়া রাখে গামছা-বান্ধা দৈ ॥"

['দেওয়ানা মদিনা' পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা,]


মদিনা তার স্বামীর সাথে সুখ-স্মৃতি বর্ণনা দিয়েছে—


"আমার মতন নাই রে আর অভাগিনী।

ভরা ক্ষেতের মধ্যে আমার কে দিল আগুণি।।"

['দেওয়ানা মদিনা' পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা,]


দুলালের বিরহ সহ্য করতে না পেরে, দুলালের উপেক্ষা সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মদিনা যখন উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে, সেই সময়ের বর্ণনা কবি দিয়েছেন


"ক্ষণে হাসে ক্ষণে কান্দে ক্ষণে গালি।

ক্ষণে গায় ক্ষণে জোকার (দেয়) ক্ষণে করতালি।।

" ['দেওয়ানা মদিনা' পালা, মৈমনসিংহ গীতিকা]


পুত্র সুরুজ জামালকে অপমান অপদস্ত করে বিদায় দেয়ার পর থেকে দুলালের মনে ভাবান্তর দেখা যায়। নিজেকে বার বার প্রশ্ন করতে থাকে তার স্ত্রী মদিনা কি মিথ্যা ? পুত্র সুরুজ জামাল কি মিথ্যা ? দুলালের বিবেক জাগ্রত হয়, সে সত্যের সন্ধান পায়। যে মদিনাকে সে উপেক্ষা করেছিল, সেই মদিনার কাছে সে ছুটে যায়। মদিনার বাড়ির কাছাকাছি এসে তার জীবনের অতীত বার বার উকি দিতে থাকে। মদিনার বয়স যখন ছয় বছর, দুলালকে ছাড়া তার চলত না। বুলবুল পাখির বাচ্চা যখন একটু একটু উড়তে শেখে, তারা দুইজন মিলে সে পাখির বাচ্চা যত্ন সহকারে লালন-পালন করেছে। দুলাল তার ঘরের কাছে এসে দেখেছে


"ঘরে কান্দে পালা বিলাই গোয়ালে কান্দে গাই।

সকলিত আছে আমার পরাণের দোসর নাই ॥


বাড়িতে ঢুকে দুলালের চোখ দুটি খুঁজতে থাকে এবং মদিনাকে ডাকাডাকি করতে থাকে সবাইকে। ডাকাডাকি শুনে এগিয়ে আসে সুরুজ জামাল।


দুলাল জিগায় সুরুজ মদিনা কোথায়।

চোখে হাত দিয়া সুরুজ কয়বর দেখায়।।



অতি সংক্ষেপে সুরুজ জামালের মুখ দিয়ে কবি এক অসাধারণ, বিশাল বিয়োগান্তক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এভাবে আমরা যদি একের পর এক 'দেওয়ানা মদিনা' পালার শিল্প গুণাবলী বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটি অসাধারণ শিল্প সফল পালা হয়েছে।




দেওয়ানা মদিনা পালার চরিত্র বিশ্লেষণ।

'দেওয়ানা মদিনা' পালার চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে কবির সাফল্য অসাধারণ। দেওয়ানা মদিনা পালায় প্রধান চরিত্র যেমন আছে, তার পাশাপাশি কিছু অপ্রধান চরিত্রও আছে। প্রধান চরিত্র যেমন- আলাল, দুলাল, মদিনা, সোনাফর দেওয়ান, সৎ মা, ইত্যাদি। অপ্রধান চরিত্রে রয়েছে জল্লাদ, সেকেন্দার দেওয়ান, সুরুজ জামাল প্রমুখ।


দেওয়ানা মদিনা পালার নায়ক কে?

মদিনার নামে পালাটির নামকরণ হলেও সমস্ত কাহিনির নিয়ামক শক্তি আলাল। এ গাথায় প্রকৃত নায়কোচিত গুণাবলি ধারণ করেছে আলাল। কেবল জ্যোষ্ঠ ভ্রাতা হিসাবে নয় তার দৃঢ়চিত্ততা, দূরদর্শীতা, বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তিত্বই তাকে নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কাহিনীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলালের অবাধ বিচরণ।


দেওয়ানা মদিনা পালার নামকরণ।

কাহিনীর মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে পাওয়া গেছে মদিনাকে। মদিনা কম সময়ের জন্য এলেও পালাটিতে প্রেমের জন্য, ভালোবাসার জন্য মদিনার অসাধারণ ভ্যাগের কারণে পালাটির নামকরণ হয়েছে মদিনার নামে,এবং মদিনা'ই এই পালার নায়িকা। প্রেম চিরন্তন। যে কবি সেই প্রেমকে তার রচনায় সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারেন, তিনিই সার্থক শিল্পী। 'দেওয়ানা মদিনা' পালায় প্রেমকে কবি অভ্যন্ত দক্ষতার সাথে সাফল্যের সাথে তুলে ধরেছেন, যে কারণে এই প্রেম কাহিনী হয়ে উঠেছে চিরন্তন এবং সার্বজনীন।


সৎ মা যে কত নিষ্ঠুর, কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, কত নীচে নামতে পারে, আলাল-দুলালের সৎ মা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে একটি মনস্তাত্বিক ব্যাপার আছে। মায়েরা সব সময় তার নিজের সন্তানের মঙ্গল চায়, কল্যাণ চায়। সন্তানের প্রতি মায়ের একটা অন্ধস্নেহ, পক্ষপাতিত্ব থাকে। নিজের সন্তানকে ছাড়া মায়েরা আর কারো কথা ভাবতে পারে না। এক্ষেত্রে সব মা-ই খানিকটা স্বার্থপর। আলাল-দুলালের মা যেমন আলাল, দুলালের স্বার্থ চিন্তা করে সংসারে সৎ মা আনতে বারণ করে গিয়েছিল তার স্বামী সোনাফর দেওয়ানকে,


সৎমা চরিত্র।

অন্য দিকে সোনাফর দেওয়ানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তার নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কিছু নিষ্ঠুর কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে। আলাল, দুলালকে সে তার সন্তানের পথের কাঁটা বলে বিবেচনা করেছে। আর সে কারণেই জল্লাদকে দিয়ে আলাল দুলালের হত্যার ব্যবস্থা করেছিল। সৎ মা চরিত্রটি আমাদের কাছে অসহনীয় হলেও তার নিজের সন্তানের পথকে নিষ্কন্টক করার জন্যই সৎ মা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সমাজে সৎ মায়ের এধরণের ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করি, কাজেই চরিত্রটি স্বাভাবিক হয়েছে।


মদিনা চরিত্র বিশ্লেষণ। 

মদিনা চরিত্রটি প্রেমের জন্য অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার করেছে। সরল প্রকৃতির এই মেয়েটি দুলালকে বিশ্বাস করেছিল, তার বাবা তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। বিয়ের আগেই দুলালের সাথে মদিনার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, বিয়ের পরে তাদের প্রেম অত্যন্ত নিবীড় এবং গভীর হয়ে ওঠে। দুলালের প্রতি মদিনার বিশ্বাস ছিল সীমাহীন, যে কারণে দুলালের কাছ থেকে তালাকনামা এলেও মদিনা বিশ্বাস করতে পারে নি, দুলাল তাকে তালাক দিয়েছে।


স্বামীর প্রতি মদিনার এই গভীর আস্থা, বিশ্বাস, তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। দুলালের কাছ থেকে উপেক্ষিত মদিনা তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে, কিন্তু তার ভালোবাসা শেষ হয়নি, মদিনার ভালোবাসা পরাজিতও হয়নি। প্রেমের পরীক্ষায় কৃষক কন্যা মদিনার জিত হয়েছে অপর দিকে দেওয়ান পুত্র দুলাল মদিনার কাছে হেরে গেছে। মদিনা চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে কবি যথেষ্ট সফল হয়েছেন।


নায়ক আলাল চরিত্র

আলাল, দুলাল দু'ভাইয়ের মধ্যে আলালের মধ্যে যে বলিষ্ঠতা আছে, দুলালের মধ্যে তা নেই। আলাল সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে, কিন্তু দুর্বল দুলাল সেই সংগ্রামের পথে এগুতে পারে নি। দেওয়ান পুত্র হিসেবে আলালের যেমনটি হওয়ার কথা, কাহিনীতে সেরূপই দেখতে পাই। জল্লাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আলাল নানা জনের কাছে বিক্রি হয়েছে। গরুর রাখালের কাজ করতে হয়েছে, কিন্তু আলাল সে জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। নানা ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে সংগ্রাম করে আলাল তার পিতার দেওয়ানী উদ্ধার করেছে, অন্যায়ের প্রতিবিধান করেছে। আলালের মধ্যে আভিজাত্যের অহমিকা কাজ করেছে, যে কারণে দুলালকে বাধ্য করেছে মদিনাকে তালাক দিতে আভিজাত্যের অহংকার যে কত ক্ষতির কারণ হতে পারে, আলালের আচরণের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে।


মদিনা কৃষক কন্যা। পিতা ইরাধর ব্যাপারী ধানের বিনিময়ে দুলালকে কিনে নিয়েছিল, পরে দুলালের সাথে মদিনার বিয়ে হয়। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। দুলাল মাঠে কাজ করতো, মদিনা বাড়ি থেকে খাবার তৈরি করে মাঠে নিয়ে যেতো। দু'জন মিলে এক সাথে সংসারের নানা কাজ করতো। একে অপরকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। তাদের কোল আলো করে একটি সন্তান আসে, নাম সুরুজ জামাল। সুখে-শান্তিতেই তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আলাল পিতৃ দেওয়ানী পুনরুদ্ধারের পর শুরু হয় জটিলতা।


আলালের ছিল অভিজাত্যের অহঙ্কার। তার কাছে মদিনার প্রেম ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। দুর্বল চিত্তের মানুষ দুলাল, ভাইয়ের চাপের মুখে মদিনাকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। সরল প্রকৃতির মেয়ে মদিনার মনে হয়েছে যে কোন মুহূর্তে তার স্বামী ফিরে আসবে, দীর্ঘদিন না আসবার ফলে মদিনার দুঃশ্চিন্তা বেড়ে গেছে, ধারণা হয়েছে হয়তো দুলালের কোনো বিপদ ঘটেছে। তার অবস্থা জানবার জন্য ছেলে সুরুজ জামাল এবং ভাইকে দুলালের খোঁজে পাঠিয়ে দিয়েছে।


তারা দুজন দুলালের কাছ থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে আসে। দুলালের এই উপেক্ষা সহ্য করতে পারে নি মদিনা। ক্ষুদা-তৃষ্ণা তার দূর হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মদিনা পাগল হয়ে গেছে। দুলাল তার ভুল বুঝতে পেরে যখন মদিনার কাছে ছুটে এসেছে, তার আগেই মদিনার মৃত্যু ঘটেছে। দুলালের উপেক্ষা মদিনার মৃত্যুর কারণ বটে, তবে শেষ পর্যন্ত প্রেমই এখানে জয়ী হয়েছে, দুলাল আর তার দেওয়ানীতে ফিরে যায় নি।


মদিনার কবরের পাশে একটি কুঁড়ে ঘর তুলে তার জীবনের অবশিষ্ট সময় কাটিয়ে দিয়েছে মদিনার প্রেমের কাছে দুলাল হেরে গেছে। তাকে পাপের প্রায়শ্চিত করতে হয়েছে। তো দুলাল চরিত্রে দ্বন্দ্বময়তা, ব্যক্তিত্বহীনতা, অদূরদর্শীতা, ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতাই তাকে প্রকৃত নায়ক চরিত্র হওয়া থেকে বিরত রেখেছে। সুতরাং এটা বলতে পারি মদিনা এবং দুলাল চরিত্র সৃষ্টিতেও কবির যথেষ্ট সাফল্য আছে।


আলাল, দুলালের ভাই হলেও চরিত্রের ভিন্নতা আছে। আলাল কখনো বিস্মৃত হতে চায় না সে দেওয়ান পুত্ৰ সমাজে তাদের প্রভাব থাকবে, খ্যাতি থাকবে, ক্ষমতার অহংকার, অভিজাতাবোধ আলালের অস্থি-সজ্জায় মিশে আছে। আর সে কারণে পিতার দেওয়ানী উদ্ধারের পর তার ছোট ভাইকে অনায়াসে বলতে পেরেছে তার বিবাহিত স্ত্রীকে তালাক দিতে। দেওয়ান পুত্রের চরিত্র এরকমই হওয়ার কথা। দুলাল হয়েছে ব্যতিক্রম। এর ফলে মদিনা এই পালার নায়িকা হলেও তার পতি দুলাল এই পালার প্রকৃত নায়ক নয়।


শুধু প্রধান চরিত্র নয়, এভাবে আমরা যদি দেওয়ানা মদিনা পালার অপ্রধান চরিত্র যেমন সোনাফফর দেওয়ান, সেকেন্দার দেওয়ান, জল্লাদ প্রভৃতি চরিত্র একে একে বিচার-বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে,পালাটির প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত হয়ে উঠেছে।


দেওয়ানা মদিনা পালার প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য।

'দেওয়ানা মদিনা' পালায় লোক কবি বেশ কিছু উপমা প্রয়োগ করেছেন, যে গুলো পালাটিকে উন্নতমানের শিল্প হতে সহায়তা করেছে। কাহিনিতে দেখি সোনাফর দেওয়ান স্ত্রীর কাছে যে ওয়াদা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করতে পারেন নি। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। ঘরে আলাল দুলালের সৎ মা এসেছে। সৎ মায়ের ষড়যন্ত্র। ছল-চাতুরীর মাধ্যমে আলাল-দুলালকে তার কাছে নিয়ে এনেছে। বাইরে আলাল-দুলালকে আরো যত্ন করলেও ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। যেই ষড়যন্ত্রের বহিপ্রকাশ ঘটেছে সৎ মায়ের আচার আচরণে। সৎ মায়ের চরিত্র নিয়ে যে উপমাটি প্রয়োগ করা হয়েছে, তা হলো—


"বগা যেমন কউখ বুজজ্ঞা সাগরের ধারে।

সাধু অইয়া বস্যা থাক্যা পুডী মাছ ধরে ॥"


আপাতদৃষ্টিতে কাহিনিটিতে ঐক্যর অভাব আছে বলে মনে হয়। দুলালের জীবনের দুটি ঘটনার বিস্তৃতিতে গীতিকাটি কিছুটা দ্বিধাদীর্ণ। বিমাতার ষড়যন্ত্রে আলাল-দুলালের জীবনান্ত হবার আশঙ্কা ও ভাগ্যবল তাদের জীবনলাভ রূপকথার ছাঁচে রচিত, যা 'ঠাকুমার ঝুলি'র শীত-বসন্তের গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুলালের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার জন্য আপন প্রিয়তম পত্নীকে অস্বীকার এবং তার ফলে জীবন-বিফলতা কাহিনীর অপর স্বাধীন অংশ।


এই দুই অংশের সম্বন্ধটি কি অচ্ছেদ্য? অবশ্য গ্রীক ট্র্যাজেডির অতি সরল এবং কিছুমাত্র দ্বিধাহীন একমুখিন ঐক্যের কথা ছেড়ে দিলে মদিনা পালায় ঐক্য একেবারেই ব্যাহত হয়েছে একথা বলা চলে না। মদিনা পালায় দুলাল-মদিনার প্রেম-বিচ্ছেদ ও মৃত্যুর কাহিনিটিই প্রধান। কিন্তু দুলালের জীবনের পূর্ব-কাহিনী এই ট্র্যাজেডির সম্ভাব্যতাকে বাস্তব করে তুলেছে। দুলালের দেওয়ানি আভিজাত্য তার রক্তের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু এতকাল লুপ্ত ছিল; তা না হলে তার দেওয়ানি লাভ কাহিনি হিসেবে রূপকথার মতো অবাস্তব এবং দেওয়ানি লাভের সঙ্গে সঙ্গে মদিনাকে তালাকনামা লিখে দেওয়া কেবলই অর্থলিপ্সুতার পরিচয় হত।


বিশেষ করে আলালের অকপট ভ্রাতৃস্নেহ এ গল্পের ট্র্যাজেডিকে একটি অভিনব সুর দিয়েছে। বাইরের কোনো শত্রু ট্র্যাজেডির বাস্তব ঘটনাগত পরিবেশ সৃষ্টি করেনি, ভাইয়ের ঐকান্তিক ভালোবাসাই এই বেদনাকে বহন করে এনেছে। তবুও স্বীকার্য যে প্রথম দিকের কাহিনি অংশের অভিপল্লবিত বিস্তৃতি ঐক্যের কিছুটা হানি ঘটিয়েছে। সামাজিক মর্যাদাবোধ ও শ্রেণীবিরোধ বর্তমান থাকায় পালাটিকে ট্রাজেডি সম্ভাবিত করেছে। কিন্তু এই সমাজশক্তি কেবল বাইরে থেকে এসে দুলাল ও মদিনার জীবনকে ব্যর্থ করে দেয়নি।


এর ক্রিয়া চলেছে দুলালের মনোজগতে। দুলালের মনে দ্বন্দ্বের একটি বীজও কবি বপন করেছেন। সে যুগে কাব্যে মানস-দ্বন্দের বিশ্লেষণ দেখাবার কোনো সুযোগ থাকলে দুলাল চরিত্রটি অতি উচ্চ ট্র্যাজিক গৌরবে মহিমান্বিত হতে পারত। একদিকে মদিনার সঙ্গে তার আবাল্যবর্ধিত প্রেম, অন্যদিকে তার নবলব্ধ সামাজিক মর্যাদা। সে দেওয়ান হয়ে সামান্য চাষা কন্যাকে কি করে স্বীকার করবে আপন পত্নী বলে ?


সে সুরুজ জামালকে ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু আপন হৃদয়দ্বন্দ্বের সমাধান করতে পারেনি। অন্তরের গভীরে সমাজপার্থক্যকে সে স্বীকার করতে পারেনি। তাই যখন দেখি জীর্ণ বসনের মতো দেওয়ানির ভক্তকে পদদলিত করে সে গ্রামের অভিমুখে চলেছে তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে হৃদয়ান্তরালে ক্রিয়াশীল মানস-দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত তাকে এই পথে নিয়ে গেছে।


এভাবে আমরা যদি 'দেওয়ানা মদিনা'র কাহিনি বিন্যাস, সমাজ চিত্র, চরিত্র সৃষ্টি, ঘটনার নাটকীয়তা, গতিশীলতা, মদিনা ও দুলালের প্রেমের স্বরূপ, নায়ক নায়িকার দ্বন্দ্ব সংঘাত, পালায় কবির উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং পালাটির ট্রাজেডির রূপ ইত্যাদি বিষয়ে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটি গীতিকা হিসাবে শিল্প সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।


দেওয়ানা মদিনা।দেওয়ানা মদিনা পালার রচয়িতা কে।দেওয়ানা মদিনা পালার সমাজ চিত্র। দেওয়ানা মদিনা কোন কাব্যের অন্তর্গত।দেওয়ানা মদিনার চরিত্র।দেওয়ানা মদিনা পালার চরিত্র।দেওয়ানা মদিনার নায়িকার নাম কি।দেওয়ানা মদিনা পালার মদিনার চরিত্র।ময়মনসিংহ গীতিকা দেওয়ানা মদিনা।দেওয়ানা মদিনার কাহিনী।দেওয়ানা মদিনা পালার শিল্পমূল্য। দেওয়ানা মদিনা পালার সার্থকতা বিচার কর।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ